সুন্দরবনে আগুন কেন?
প্রকাশিত : ১২:০৬, ৭ মে ২০২১
সম্প্রতি পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিস, বন বিভাগ ও স্থানীয়দের প্রায় ৩০ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় মঙ্গলবার (৪ মে) বিকেল ৫টায় আগুন নিভে যায়। পরবর্তীতে বুধবার (৫ মে) সকালে পূর্বের অগ্নিকাণ্ডের দক্ষিণ পাশে আবারও আগুন লাগে। এ নিয়ে গত ২০ বছরে সুন্দরবনে ২৬ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল।
ধারবাহিক এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্তও হয়। তদন্ত রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর বনবিভাগ দৃশ্যমান কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তা কেউই জানেনা। যদিও ওই রিপোর্টে জেলে-বাওয়ালীদের ফেলে দেওয়া বিড়ি সিগারেটের আগুন থেকে সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় বলেই উল্লেখ করা হয়।
তাহলে সেই জেলে বাওয়ালীদের সুন্দরবনে প্রবেশে কখনও কী কঠোর বিধি আরোপ করা হয়েছে? সে প্রশ্নে বাগেরহাটের বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন দাবি করেন, ইতোপূর্বে সুন্দরবনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বেশ কয়েকজককে আসামি করে মামলা দেওয়া হয়েছে।
তাতেও কি এই দুর্ঘটনা কমেছে? জানতে চাইলে এই বনকর্মকর্তা বলেন, এলাকার লোকজন সচেতন না হলে আমাদের কি করার আছে বলেন!
এদিকে গত ৩ মে বনের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় নতুন করে যে আগুনের ঘটনা ঘটে, তা অনেক ভয়াবহ বলেই জানা গেছে। দু’দফায় আগুন নেভানোর পরও নিভলোনা সেই আগুন। বৃহস্পতিবার (৬ মে) তৃতীয় দফায় বিকেল ৫টা পর্যন্ত দমকল বাহিনী প্রাণপন চেষ্টা করেও পুরোপুরি আগুন নিয়ন্ত্রনে আনতে পারেনি।
যদিও পূর্ব সুন্দরবনের ডিএফও (বিভাগীয় বনকর্মকর্তা) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেনের দাবি, ‘আগুন নিভেছে, তবে কিছু জায়গায় ধোঁয়া বের হচ্ছে, সেটি আগুন নয়।‘
সোমবারের এই আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রধান পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের এসিএফ (সহকারী বন সংরক্ষক) মোঃ জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘একই জায়গায় তিন দফায় আগুনের ঘটনা ঘটায় এখনও তদন্তের কাজ শুরু করতে পারিনি, তবে এবারের আগুনের কারণ এখনও খুঁজে পায়নি। ধারণা করা হচ্ছে- বনের পাতা পঁচে গিয়ে মিথেন গ্যাস তৈরি হয়ে আগুন লাগতে পারে’।
তবে ওই বন কর্মকর্তার ধারণা সঠিক নয়- উল্লেখ করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের শিক্ষক মোঃ আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, মিথেন গ্যাস তৈরী হয় আবদ্ধ জায়গায়, এটাতো ওরকম নয়। বিসৃত জায়গা ঘিরে সুন্দরবনে এটা হতে পারেনা।
তিনি বলেন, এখন মধু আহরণ চলছে, মৌওয়ালরা মধু আহরণ শেষে তাদের ব্যবহৃত আগুনের মশাল বনের যে কোনও জায়গায় ফেলে রাখায় সেখান থেকে আগুন লেগেছে। আর অনাবৃষ্টির কারণে সুন্দবনের শুকনো ডালপালা ও পাতায় সেই আগুন লাগায় এর তীব্রতা বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
সুন্দরবনে ধারবাহিক এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বনেরই ক্ষতি হচ্ছে জানিয়ে সমাজ বিজ্ঞানের এই গবেষক বলেন, ‘বনে আগুনের ঘটনায় প্রথমত মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া বনে পাতার নিচে সরিসৃপ প্রাণী সাপ, গুইল, ব্যাঙসহ অন্যান্য প্রাণী মরে যাচ্ছে আগুনের তাপে। এমনকি এসব প্রাণীর ডিমও নষ্টসহ মৌমাছির বাসাও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আর যেসব জায়গায় আগুন লেগেছে সেসব জায়গার বীজ থেকে আর কখনও চারা জন্মাবেনা‘ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সেভ দ্য সুন্দরবনের চেয়ারম্যান ডক্টর শেখ ফরিদুল ইসলাম ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির ষ্টিয়ারিং সদস্য মোঃ নুর আলম শেখ বলেন, সুন্দরবনে বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। কিছু অসাধু মুনাফালোভী ব্যক্তি তাদের হীন স্বার্থে পরিকল্পিতভাবে আগুন দিয়ে এই বনকে ধ্বংস করছেন।
এক্ষেত্রে তারা বনবিভাগের কর্তাব্যক্তিদের দায়ী করে বলেন, বনের অভ্যন্তরে টাকার বিনিময়ে বনকর্তারা কিছু জেলে ও মৌওয়ালদের ঢুকাচ্ছে। তারা মাছ ও মধু আহরণের নামে বনে আগুন দিচ্ছে। এটা ঠেকাতে না পারলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও কমবেনা বলেও জানান তারা।
বন বিভাগের তথ্যমতে, সুন্দরবনে ১৬ বছরে ২৮ বার আগুন লেগে পুড়ে যায় প্রায় ৮০ একর বনভূমি। ২০১৭ সালের ২৬ মে পূর্ব সুন্দরবনে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ফরেস্ট ক্যাম্পের আওতাধীন আবদুল্লাহর ছিলায় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই আগুনে প্রায় পাঁচ একর বনভূমির ছোট গাছপালা, লতাগুল্ম পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
এনএস/
আরও পড়ুন