ঢাকা, সোমবার   ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

করোনায় থামছে না কুড়িগ্রামে বাল্য বিবাহ

আতাউর রহমান বিপ্লব, কুড়িগ্রাম

প্রকাশিত : ১৬:৩৮, ৬ আগস্ট ২০২১ | আপডেট: ১৬:৪৮, ৬ আগস্ট ২০২১

করোনার মহামারী আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে কুড়িগ্রামে ক্রমেই বেড়ে চলেছে বাল্যবিবাহ। দারিদ্র পীড়িত উত্তরের এই জনপদে কন্যা সন্তানকে বোঝা হিসেবে দেখেন এখানকার অভিভাবকরা। সামাজিক কুসংস্কার আর দারিদ্রতার কষাঘাতে অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হচ্ছে কিশোরীদের। যে বয়সে তাদের হাতে থাকার কথা কলম, সেই হাটে এখন সংসারের চাবি। করোনার প্রভাবে এসব শিক্ষার্থীদের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্যোগ। 

সরেজমিনে দেখা যায়, রৌমারী উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়নের সীমান্ত ঘেঁষা বাগবান্ধা গ্রামে রাতের রান্নাবান্না করছে ৫ম শ্রেণীর ছাত্রী চৌদ্দ বছরের কিশোরী রূপালী খাতুন। মাটির চুলোয় খড়ির আগুনে কড়াইতে মাছের টুকরা ভাজতে দেখা যায় রূপালীকে। 

স্বামী মঞ্জু মিয়া রৌমারী-ঢাকা বাসের হেলপার। গত বছরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ করে বিয়ে দেয় রূপালীর পরিবার। দিন-মজুর হেলাল উদ্দিন-ফুলবানু দম্পতির মেঝকন্যা রূপালী। 

করোনার প্রভাবে একদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ অন্যদিকে হাতে কাজ না থাকায় ৫ম শ্রেণী পড়ুয়া রূপালীর বিয়ে দিয়ে দেন বাবা-মা। তুলনামূলক এই চরাঞ্চলগুলোতে বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে থেকে বেশি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় রূপালীর মতো রাজিবপুর উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার কোদালকাটি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী নুরি আক্তারের বিয়ে হয় ২৪ ডিসেম্বর। 

রুপালী, মমতাজ, ফাতেমা, নুরিসহ বহু মেয়ে বাল্যবিয়ের স্বীকার হয়েছে গত দেড় বছরে। বাল্যবিয়ের দৃশ্য জেলার চরাঞ্চলগুলোতে হরহামেশাই ঘটছে। এই জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা ও দুধ কুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর ছোট-বড় প্রায় ৫'শতাধিক দ্বীপচর চরাঞ্চল রয়েছে। এসব চরাঞ্চলে প্রাইমারী কিংবা উচ্চ বিদ্যালয়ের গন্ডি পার হবার আগেই বিয়ের পীড়িতে বসতে হয়। প্রত্যন্ত এসব চরাঞ্চলগুলোতে ধর্মীয় চিন্তা, কুসংস্কার ছাড়াও অভাব, দারিদ্রতার কারণে অল্প বয়সে বিয়ে দেন অভিভাবকেরা। 

একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্যানুযায়ী-২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত জেলায় ২১ হাজার ১০০টি বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। এরমধ্যে নিবন্ধিত বিয়ের সংখ্যা-১৭ হাজার ৯৮৪টি এবং অনিবন্ধিত বিয়ের সংখ্যা-৩ হাজার ১১১টি। জেলার ৯টি উপজেলায় বাল্যবিয়ে হয়েছে ২ হাজার ৯৫৩টি। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ হয়েছে ১ হাজার ১২০টি। এরইমধ্যে কুড়িগ্রাম সদর-৭০২টি, রাজারহাট-৭৩টি,উলিপুর-২৫৯টি, চিলমারী-১৪০টি, রৌমারী-৮৪টি, রাজিবপুর-৪৯টি, নাগেশ্বরী-১১২৮টি, ফুলবাড়ি-২৯১টি, ভূরুঙ্গামারীতে-২২৭টি বাল্য বিয়ে  হয়েছে। যদিও করোনার লকডাউন চলাকালিন সময় জরিপের কার্যক্রম কিছুটা স্থবিরতা হয়ে পড়েছে। ফলে জেলার বাল্যবিয়ে হার বাস্তবতার আলোকে আরো অনেক বেশি। 

বাল্যবিবাহের শিকার রূপালী বলেন, 'আমার বাবা-মায়ের থাকার জমিজমা নেই। অভাবে পড়েই বিয়ে দিয়েছে। স্কুলও বন্ধ। খাবারের সমস্যা। এজন্যই বিয়ে দিছে। 

নুরি আক্তার বলেন, রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী। বাবা-মা ভালো পরিবার পাইছে তাই বিয়ে দিয়েছে। স্কুল বন্ধ থাকায় বাড়িতে থাকার কারণে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই বিয়ে দিছে। এমন অনেক মেয়েরই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। 

দিনমজুর হেলাল উদ্দিন বলেন, কাজকর্ম নাই। মেয়েকে যত বড় করমো ততই ডিমান্ড বাড়বে। তাতে স্কুল বন্ধ। অভাবের মধ্যে খরচ বেশি হয়। সেজন্য মেয়েকে কম বয়সেই বিয়ে দিয়েছি। যৌতুক ৩০ হাজার টাকার মধ্যে নগদে দিছি ১৫ হাজার টাকা দিয়া বেটি পার করছি। 

কোদালকাটি এলাকার মজিবর বলেন, 'এই চরের মধ্যে বাহে বেটির কোন নিরাপত্তা নাই। আর নেকা পড়া করিয়া কি করবে? করোনার কারণে আগের মতন আর কাম কাইজ নাই। খাওয়াইয়া বেশি। ছোটতে বিয়া দিলে যৌতুক কম নাগে তাই বেটিক বিয়া দিছি।' 

একই এলাকার মমতাজের মা মহেলা বেগম বলেন, 'করোনার কারণে ৬ষ্ট শ্রেণীতে থাকতে বিয়ে দিয়েছি। করোনার কারণে পড়া লেখা নাইকা। কাম-কাজ নাইকা। বিয়া না দিয়া উপায়ও নাই। চিলমারীতে মমতাজের বিয়া দেছি। স্কুল বন্ধ থাকায় এই গ্রামে অনেকেই তাদের মাইয়ার বিয়া দিয়া দেওছে বাপ-মাও।' 

স্থানীয় বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ বলেন, চরাঞ্চল এলাকা হওয়ায় এখানে বাল্যবিয়ের হার অনেক বেশি। পিতা-মাতাকে নিষেধ করলেও তারা গোপনে পার্শ্ববর্তী চিলমারী উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে গিয়ে গোপনে বিয়ে দেন। তারা ভুয়া জন্ম সনদ দিয়ে এসব বিয়ে পড়ালেও পরবর্তিতে দেখা যায় মেয়ের অভিভাবকরাই বিপদে পড়েন। যৌতুকের টাকা কিংবা অভাবের কারণে বাল্য বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটতেছে অহরহ। কাজীরা বাল্যবিয়ে পড়ার কারণে বিয়ের আসল কাগজপত্র দেয় না। ফলে আইনি সহযোগিতা থেকেও মেয়ের অভিভাবকরা কোন আইনি সহায়তা পায় না।    

রৌমারী যাদুরচর ইউপি চেয়ারম্যান সরবেশ আলী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুযোগে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পাবার কথা স্বীকার তিনি। ছেলে-মেয়েদের বয়স লুকিয়ে অন্য উপজেলা কিংবা অন্য ইউনিয়নে নিয়ে গিয়ে পারিবারিকভাবে বিয়ে দেন। আবার এমনও ঘটনা ঘটে শুধুমাত্র হুজুর ডেকে কলেমা পড়িয়ে বিয়ে দেয়া হচ্ছেও।বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকারকে আরও কঠোর হবারও আহবান জানান তিনি।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুযোগে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে স্বীকার করেন। তিনি অরও বলেন, আমাদের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ চেয়ারম্যানরা সজাগ রয়েছে। ইনশাল্লাহ যেকোন সময় আমরা বাল্যবিয়ের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করব, আইনি ব্যবস্থাও নেয়া হবে বলে তিনি জানান। 
কেআই//
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি