পর্যটক দেখলেই দলবেঁধে ছুটে আসে বানর
প্রকাশিত : ১৮:৩৫, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | আপডেট: ১৮:৩৭, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২
সুন্দরবনের বানর
ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ন্ড হেরিটেজ সাইট বিশ্বের বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবন। বাঘ ও হরিণের পরই এ বনের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে বানরগুলোই। বনের মধ্যে যেদিকেই চোখ যায়, শুধু সৌন্দর্য্যের প্রতীক বানর আর বানরের চেচামেচি। সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্য্যকে আলিঙ্গন করে রেখেছে এ বানরগুলো।
চলতি শীত মৌসুমে ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রগুলো এখন মুখর পর্যটকদের পদচারণায়। সুন্দরবনের করমজল পর্যটন কেন্দ্র তার মধ্যে অন্যতম। পর্যটকদের দেখলেই এখানে খাদ্যের আশায় দল বেঁধে ছুটে আসে বানরগুলো।
এসময় পর্যটকরা বানরদের পোট্যাটো চিপস, সফট ড্রিংকসসহ বিভিন্ন ধরণের খাবার খাইয়ে থাকেন। শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারী) এই পর্যটন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা মেলে এমনই চিত্র।
তবে এতে সুন্দরবনের বানরদের খাদ্যভ্যাস বদলে যাচ্ছে বলেই আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে সুন্দরবনের বানর আর আগের মতো গাছের ফল-মুল, কচিপাতা বা কাঁকড়া ধরে খাচ্ছে না।
এই অভ্যাস বদলের ফলে বানরের উৎপাতে স্বাভাবিক জনজীবন ব্যাহত হওয়া ছাড়াও বিপজ্জনক আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন সেভ দ্য সুন্দরবনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, মানুষের এত কাছাকাছি থাকার কারণে নানা ধরনের রোগ সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে বানরের, যা গভীর জঙ্গলে মহামরীর মতোই ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে গোটা সুন্দরবনেরই পরিবেশগত ভারসাম্য যে নষ্ট হবে, সেটা বলাই বাহুল্য। এছাড়া বানরের খাদ্যাভ্যাস বদলে যাওয়াতে প্রাকৃতিক স্থিতিও কিছুটা নষ্ট হচ্ছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হারুন বলেন, সুন্দরবনে বানরের দল যেমন গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে বেড়ায়, জমিতে তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলে হরিণের দল এবং অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণি। কারণ বানর গাছে উঠে যত ফল খায় বা পাতা ছিড়ে খায়, তার থেকে বেশি ফল-পাতা নীচে ফেলে, যা হরিণেরা কুড়িয়ে খায়।
বানর-হরিণ যুগলবন্দীর আরও একটা কারণ আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বানরের সঙ্গে হরিণের ঘুরে বেড়ানোর আরও যে একটা কারণ আছে, সেটা একেবারেই প্রাণের তাগিদ। বাঘ শিকার ধরতে এলে গাছের উঁচু ডালে বসা বানর সেটা সবার আগে দেখতে পায় এবং চিৎকার করে সবাইকে সতর্ক করে দেয়, তাতে সাবধান হয়ে যায় হরিণের দলও। জঙ্গলের এই চিরায়ত নিয়মও এখন ব্যাহত হচ্ছে, ফাস্ট ফুডের লোভে বাঁদরের দল জঙ্গলছাড়া হওয়ায়।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের হরিণ, বানর, শূকর, উদবিড়াল বা ভোঁদড়ের সবশেষ শুমারি হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। সেই শুমারির তথ্য অনুযায়ী, বনে বানর আছে ৪০ থেকে ৫০ হাজার।
সুন্দরবনে আসা পর্যটক রবিউল ইসলাম ও হাফিজুর রহমান বলেন, করমজল পর্যটন কেন্দ্রে ঢোকার সময় আমাদের সঙ্গে রুটি ও চিপস ছিল। কিন্তু সাথে সাথেই কয়েকটি বানর দল বেঁধে এসে ছোঁ মেরে সেই খাবার নিয়ে যায়। তারা বলেন, হয়ত তাদের ক্ষুধা পেয়েছে, তাই নিয়ে গেছে।
তবে এই বানরের উৎপাতের কারণ হিসেবে তাদের খাদ্য সংকট বলতে নারাজ পূর্ব সুন্দরবনের করমজল বণ্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির।
তিনি বলেন, বণ্যপ্রাণী সবসময় লবণ জাতীয় খাবার পছন্দ করে। এখানে যখন পর্যটকরা আসেন, তারা ওই সব প্রাণিদের খাবার দেন। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, বানরগুলো কোনো লোক দেখলেই মনে করে তার কাছে খাবার আছে। এসব কারণে কোনো কোনো পর্যটকের ওপর আক্রমণও করে বসে এসব বানর। ওদের চরিত্র নষ্ট হয়ে এখন রাক্ষুসে ভাব হয়ে গেছে।
এতে আশঙ্কা প্রকাশ করে এই পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হারুন বলেন, “ট্যুরিস্ট রিসোর্ট হয়ত বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু তাদের উচ্ছিষ্ট খাবার ফেলাকে নিয়মে বাঁধতে হবে। ঢাকনা দেয়া আবর্জনার পাত্রে সেইসব উচ্ছিষ্ট ফেলে এবং প্রতিদিন নিয়ম করে সেটা পরিস্কার করতে হবে। আর বানরের খাবার দেয়াও বন্ধ করতে হবে পর্যটকদের। আচরণবিধি না মানলে শাস্তি বা জরিমানা করতে হবে। সময় থাকতে সাবধান না হলে এক ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়াবে গর্বের সুন্দরবন”।
এনএস//
আরও পড়ুন