এক পরিবারের ১১ শহীদের পঞ্চাশ বছর, খোঁজ রাখেনি কেউ
প্রকাশিত : ০৮:৪৯, ১১ এপ্রিল ২০২২
পারকোল গ্রামে ১৭ শহীদের গণকবর
আজ ১১ এপ্রিল। ’৭১-এর এই দিনে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধের সময় শহীদ হয়েছিলেন নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার নগর ইউনিয়নের পারকোল গ্রামের একই পরিবারের ১১ জন। এছাড়া ওই পরিবারের ২ সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।
কানু সরকার ও ওসমান আলী সরকার নামে গুলিবিদ্ধ সেই ২ সদস্য ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছেন যুগের পরে যুগ। দীর্ঘ ৫০ বছরেও এই শহীদ পরিবার রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি না পাওয়ায় তাদের শারীরিক যন্ত্রণার সাথে যুক্ত হয়েছে মানসিক যান্ত্রণাও।
এছাড়া ওই পরিবারের ১১ শহীদসহ ১৭ শহীদের গণকবরও পড়ে রয়েছে অবহেলা ও অরক্ষিত অবস্থায়।
এসব শহীদ ও যুদ্ধাহতদের সরকারি সুযোগ-সুবিধাসহ রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ এলাকাবাসী ও পরিবারের সদস্যরা।
১৯৭২ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধের মুক্তিকামী বাঙালি যোদ্ধারা নাটোরের বিভিন্ন এলাকায় পাকসেনাদের প্রতিরোধে প্রস্তুতি নিতে থাকে। বড়াইগ্রাম উপজেলার ধানাইদহ এলাকায় ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের ওপরে ধানাইদহ ব্রিজ পাহারায় ছিলেন তৎকালীন ইপিআর, পুলিশ-আনসার সসদ্যসহ মুক্তিযোদ্ধারা।
১১ এপ্রিল, এই দিন চোখের সামনে বাবা-মা ও ভাইবোনসহ পরিবারের ১১ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করতে দেখেছেন শহীদ শুকুর আলী সরকারের ছেলে কানু সরকার। এছাড়া তিনি নিজে এবং তার চাচা ওসমান আলী সরকার গুলিবিদ্ধ হন।
কানু সরকার জানান, “চোখের সামনে তার বাবা শুকুর আলী সরকার, মা কাঞ্চনী বেগম, ভাই জানু সরকার, দাদী বাবুনি বেগম, বড় আব্বা ছবি সরকার, বড়মা গোলাপী বেগম, তাদের মেয়ে জালেদা খাতুন, আরেক চাচা আছের উদ্দিন সরকার, চাচী জয়েনা বেগম, চাচাতো ভাই জাহাঙ্গীর আলম ও ফুপাতো ভাই মজব আলীর উপর প্রকাশ্য ব্রাশফায়ার চালায় পাকসেনারা। গুলিতে সবাই শহীদ হন।”
“আমি ও আমার চাচা ওসমান আলী সরকার এসময় গুলিবিদ্ধ হই। পাকসেনাদের ছোড়া গুলি এসে আমার বাম পায়ের হাঁটুতে লাগে এবং আমার পাশে থাকা চাচা ওসমান আলীর মাজায় লেগে গুলি বেড়িয়ে যায়। রক্তে সয়লাব হয়ে যায়, যন্ত্রনায় ছটফট করছিলাম দু’জন।”
“তবে পাকসেনাদের নজরে যেন না পড়তে হয় সেজন্য দু’জনার কেউ কোন টু-শব্দ করিনি। একদিকে বাবা-মা সহ পরিবারের লোকদের মৃত্যু দেখে ডুকরে কাঁদতেও পারছিলামনা। তেমনি যন্ত্রনায় গোটা শরীরে কাঁপুনি শুরু হলেও সাহায্যের জন্য কাউকে চিৎকার করে ডাকতেও পারছিলামনা, বলেন এই যুদ্ধাহত।”
“পাকসেনারা চলে যাওয়ার পর আমরা বের হয়ে আসি। এসময় অনেকেই ছোটাছুটি করে নিরাপদ দূরত্বে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। স্থানীয়রাই আমাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন। পরে নিহতদের বাড়ির পাশে বাঁশ বাগানের মধ্যে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। আমরা পরিবারের যেকজন জীবিত ছিলাম তারা নিরাপদ স্থানে সরে যাই।”
স্বাধীনতার পর ওই গণকবর চিহ্নিত করে পাকা করা হয়।
স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বড়াইগ্রাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আব্দুস সাত্তার জানান, ’৭১-এর ১১ এপ্রিল পাকসেনাদের একটি দল ঢাকা-নাটোর মহাসড়ক দিয়ে নাটোরের দিকে আসার পথে ধানাইদহ ব্রিজের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এসময় ভারি অস্ত্রে সজ্জিত পাকসেনাদের একটি দল পিছু হটে পারকোল গ্রামের মধ্যে ঢুকে এলোপাতারি গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এসময় ধানাইদহ ব্রিজ এলাকায় মাহাবুব আলী ও সিরাজুল ইসলাম নামে দুই আনসার সদস্যসহ অন্তত ২০ জনমুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাদের কয়েকজনকে ব্রিজের পাশে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়।
সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার আরও জানান, ইপিআর, আনসার ও পুলিশ সদস্যসহ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম প্রতিরোধে বাধা পেয়ে পাকসেনাদের একটি দল গ্রামের পথ ধরে পারকোল গ্রামে ঢুকে পরে। ওই গ্রামে প্রবেশের পথে এলাপাতারি গুলিবর্ষণসহ বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ করে তারা। এসময় প্রতিরোধের চেষ্টা করলে ওই গ্রামের ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এদের মধ্যে শুকুর আলী সরকারসহ তার পরিবারের নারী-পুরুষ মিলে ১১ জন শহীদ হন।
তিনি আরও জানান, পাকসেনারা চলে যাওয়ার পর নিহতদের একটি বাঁশ বাগানের মধ্যে গণকবর দেয়। স্বাধীনতার পর স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনুদানে গণকবর পাকা করে চিহ্নিত করে এলাকাবাসী। এরপর গত ৫০ বছরেও আর এই গণকবর ও শহীদদের খোঁজ নেয়নি কেউ।
এসব শহীদ ও যুদ্ধাহত পরিবারকে রাষ্ট্রিয়ভাবে তালিকা করাসহ সরকারি সহায়তার দাবি জানিয়েছেন শহীদ পরিবার ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।
বড়াইগ্রাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার শামছুল হক জানান, ১১ শহীদের ওই পরিবারকে শহীদ পরিবারের মর্যাদা দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলে আবেদন করা হয়। কিন্তু কোন কাজ হয়নি।
জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, একই পরিবারের ১১ জন শহীদ হয়েছেন এমন খবর জানার পর তাদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন তিনি। দীর্ঘদিনেও তাদের কেউ খোঁজ নেয়নি এমন খবর তাকে পীড়া দিয়েছে। তাদের জন্য যে ধরনের সহায়তার প্রয়োজন তা করবেন বলে জানান তিনি।
এএইচ/
আরও পড়ুন