ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

কৃষকের চোখের সামনেই তলিয়ে গেল কষ্টের ফসল

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ০৮:৪৭, ১৯ এপ্রিল ২০২২

সর্বশক্তি দিয়ে বাঁধ ঠেকানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা। রাত জেগে চলছে পাহারা, তবুও বাঁধ রক্ষা করা যাচ্ছে না। কৃষকের চোখের সামনেই তলিয়ে গেল মাঠের সোনালী ফসল। হা-হুতাশের অন্ত নেই, কাঁদছে কৃষক।

কিছুতেই কিছু হচ্ছে না, বাঁধ ভাঙছেই। চোখে অমানিশার অন্ধকার দেখছেন কৃষকরা। বাড়ছে কান্না। ফসল নেই, ধারদেনায় নিমজ্জিত। পরিবার নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। অথচ এমন পরিস্থিতির জন্য এবার কৃষকরা প্রস্তুত ছিলেন না। আশায় বুক বেঁধেছিলেন তারা। ফসল ঘরে উঠবে। গোলা ভরা থাকবে ধানে। মুখে থাকবে হাসি। সব যেন চোখের সামনেই হারিয়ে যাচ্ছে।

সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ হাওর এলাকা। এ দুই জেলাকে বলা হয় ফসলের ভাণ্ডার। এক ফসল হয় হাওরে। আর সেটি হচ্ছে বোরো। বৈশাখে কাটা হয় সেই ধান। হাওরের এই ফসল নিয়ে প্রতিবছরই থাকে শঙ্কা। হঠাৎ হঠাৎ উজানের ঢল এসে তলিয়ে যায় সবকিছু। 

সেই শঙ্কা এবার সত্যে পরিণত হলো। অথচ করোনা পরবর্তী সময়ে এবারের ফসল কৃষকদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য অতি জরুরি ছিল। 

এজন্য সরকারের তরফ থেকেও কম করা হয়নি। আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল সরকার। 

সুনামগঞ্জের হাওরে ছোটো বড় মিলিয়ে বাঁধ ৭১৬টির মতো। প্রতিবছরই সরকার শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে হাওরে বাঁধ দেয়। এবার সুনামগঞ্জের হাওরে বাঁধ নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ১২১ কোটি টাকা। যথা সময়ে টাকাও বরাদ্দ দেয়া হয়, কাজও হয়। কিন্তু ঢলের তোড়ে বাঁধ যেনো তাসের ঘরের মতো উড়ে উড়ে যাচ্ছে। 

ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ২০টি বাঁধ ভেঙে গেছে। হাওর এখন পানিতে টুইটুম্বুর। আর ফসল পানির নিচে দাঁড়িয়ে আছে। কৃষকরা চেয়ে চেয়ে দেখছেন। কিছুই করার নেই। 

কৃষকদের মতে- এবারও হাওরে সরকারের শতকোটি টাকা তলিয়ে গেল পানিতে। টাকা খরচ করেও কাজ কিছুই হলো না। বরং পানিভর্তি হাওরে বাঁধ এখন কৃষকদের কাছে চোখের বালি। 

হাওরে এবার আঘাত হানে এপ্রিলের প্রথমদিকে। এই সময়ের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। কৃষকরা মধ্য মে পর্যন্ত সময় পেলে ধান গোলায় ভরতে পারতেন। কিন্তু এবারের ঢলে বাঁধ কোনো কাজেই আসছে না। 

তাদের মতে- হাওরে বাঁধ নির্মাণে এবারও সীমাহীন দুর্নীতি হয়েছে। কাজ হয়েছে নিম্নমানেন। টাকা লুটপাট করা হয়েছে। 

প্রায় ১০ দিন আগে হঠাৎ করে ভারতের মেঘালয় থেকে ঢল নামে। এতেই হাহাকার শুরু হয় সুনামগঞ্জে। সরকারের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত এ নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু হয়। গত সপ্তাহে সুনামগঞ্জ সফর করেন পানি সম্পদ উপমন্ত্রীও। সফরকালেই তিনি সচক্ষে বাঁধের অবস্থা দেখে যান। 

মন্ত্রীকে কাছে পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন কৃষকরা। ধর্মপাশায় এক কৃষক প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন। মন্ত্রীকে কাছে পেয়ে বাঁধ নির্মাণের সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। ওই কৃষক তার কাঠগড়ায় দাঁড় করান স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করায় ওই কৃষকও পরে নেতাদের কাছে হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন। 

তবে পানি সম্পদ উপমন্ত্রী সুনামগঞ্জে বসেই বাঁধের অনিয়ম পাওয়ায় ঢাকায় গিয়ে অতিরিক্ত সচিব দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটি গত সপ্তাহে সুনামঞ্জ সফর করে গেছেন। সরেজমিনে কৃষকরাও তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। তদন্ত কমিটি ঘুরে যাওয়ার দু’দিন পর পানি মন্ত্রণালয়ের সচিবও সুনামগঞ্জ ঘুরে যান। 

গত শনিবার সুনামগঞ্জ সফর করেছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকও। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে হাওরে ধান কাটার উদ্বোধন করেন। তার উদ্বোধনের দু’দিনের মাথায় ডুবে গেল হাওর। ফলে সরকারের আনুষ্ঠানিক ধান কাটা শুরু হলেও সুনামগঞ্জের হাওরের ধান গোলায় তুলতে পারলেন না কৃষকরা। 

দুটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁধ নিয়ে গত রোববার রাতভর টেনশনে ছিলেন সুনামগঞ্জের কৃষকরা। এই হাওর দুটির মধ্যে একটি হচ্ছে টাঙ্গুয়ার পার্শ্ববর্তী বর্ধিত গুরমান হাওর। হাজার কৃষক রাতভর বাঁধের উপরেই ছিলেন। ওই বাঁধ ভেঙে গেলে তলিয়ে যাবে অনেক হাওর। সকালে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। টিকলো না বাঁধ। 

চোখের সামনেই বাঁধ উপচে, আবার কোথাও বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে গেল হাওরে। 

গুরমার হাওরের কৃষকরা জানিয়েছেন, ওই হাওরের শ’ শ’ একর ধান এখন পানির তিন থেকে চার ফুট নিচে। এখনও ধান কাটার সময় আসেনি। আরও এক সপ্তাহ অপেক্ষায় ছিলেন তারা। কিন্তু তার আগেই হাওর তলিয়ে গেল। আর ক্রমাগত পানি বাড়ার কারণে তারা আর ধান কাটতে পারবেন না। 

দিরাইয়ের পুরামন্দিরা হাওর একটি গুরুত্বপূর্ণ হাওর। এই হাওরের বাঁধ রক্ষায় রোববার ভোররাত পর্যন্ত কৃষকরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। সকালের দিকে বাঁধের কয়েক স্থানে ভেঙে পানি ঢুকে গেল। কাঁদছে দিরাইয়ের পুরামন্দিরা হাওরের তীরবর্তী কৃষকরা। 

করছার হাওর এটিও সুনামগঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ একটি হাওর। এই হাওরের বাঁধ রয়েছে ঝুঁকিতে। এই বাঁধ নিয়ে কৃষকদের শঙ্কা কাটছে না। অনেকেই বাঁধে অবস্থান নিয়েছেন। ঠেকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। 

সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর সংলগ্ন গুরমা হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধটি পানির চাপে ভেঙে গেছে। এতে তাহিরপুর ও মধ্যনগর থানার ছোট বড় ১০টি হাওরের বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। 

তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রায়হান কবির বলেন, “টাঙ্গুয়ার হাওরের বাঁধগুলো নিয়েই যত সমস্যা। বাঘমারার বাঁধটি রক্ষায় ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে দিন-রাত কাজ করেছি। বাঁধের আশপাশে অন্তত তিন কিলোমিটারে কোনো বসতি নেই। লোকজন পাওয়া যায় না। শ্রমিকের সংকট। তবু এখানে পালাক্রমে বাঁধটি রক্ষার চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।”

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, “এতো পানির চাপ সামলানো কঠিন। পানি এখনও বাড়ছে। তবু অনেক বাঁধ টিকে আছে। সবখানেই কাজ করে যাচ্ছি। আগামী ৪০ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টির কোনো পূর্বাভাস নেই। এটাই আপাতত আশার কথা। 

সুনামগঞ্জে এবার প্রথম দফা পাহাড়ি ঢল নামে ৩০ মার্চ। এর ধাক্কা সামলানোর আগেই দ্বিতীয় দফা ঢল নামে। এতে জেলার সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি