স্বপ্নের সেতুকে বরণ করতে বর্ণিলসাজে বাগেরহাট
প্রকাশিত : ২০:৩৭, ২৪ জুন ২০২২ | আপডেট: ২১:০১, ২৪ জুন ২০২২
স্বপ্নের সেতু উদ্বোধনের আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। এখন চলছে কাউন্ট ডাউন। শনিবার (২৫ জুন) সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন দেশের সব থেকে বড় মেগা প্রকল্প পদ্মাসেতু। পদ্মাসেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। দক্ষিণের জেলা বাগেরহাটকে সাজানো হয়েছে বর্নিল সাজে। পদ্মাসেতু সংক্রান্ত বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন ও পোস্টারে ছেয়ে গেছে বাগেরহাট জেলা। আলোকসজ্জা করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, মহাসড়ক, সেতু ও সরকারি ভবনে। বাসস্ট্যান্ড, গুরুত্বপূর্ণ মোড়সহ বিভিন্ন স্থানে বাজানো হচ্ছে পদ্মা সেতুর থিমসং।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশনিতেও ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে এক সপ্তাহ ধরে নানা কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও মোড়ে পদ্মা সেতুর থিম সং বাজানো হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ও পদ্মাসেতুর উপর তথ্যচিত্র প্রচার, বিভিন্ন সড়কে আলোকসজ্জা ও সৌন্দর্যবর্ধণ করা হয়েছে। উদ্বোধনী দিনে সুসজ্জিত পিকআপে করে বাউল শিল্পিদের দিয়ে পদ্মাসেতুর গান বাজানো হবে, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সকলকে দেখানোর জন্য স্বাধীনতা উদ্যানে প্রজেক্টর ও সাউন্ড সিস্টেম স্থাপন, আনন্দ র্যালী, আলোচনা সভা, জেলা কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু সদনে উন্নতমানের খাবার বিতরণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও এ্যাক্রোবেটিক শো‘র আয়োজন করেছে জেলা প্রশাসন।
অন্যদিকে বাগেরহাটের দড়াটানা সেতু, মুনিগঞ্জ সেতু, মোল্লাহাটের আবুল খায়েরসেতুসহ সকল বড় বড় সেতু ও গুরুত্বপূর্ণ সড়কে আলোকসজ্জা করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সবমিলিয়ে সাধারণ মানুষের মনেও এক ধরণের অন্যরকম আনন্দ বইছে পদ্মাসেতু নিয়ে।
বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. ভুইয়া হেমায়েত উদ্দিন বলেন, পদ্মাসেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য আমাদের নেতাকর্মীরা খুবই উচ্ছসিত। জেলা থেকে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ আমরা পদ্মাসেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করব। এছাড়াও প্রতিটি ইউনিয়নে নেতাকর্মীরা আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি করবে বলে জানান এই নেতা।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, পদ্মাসেতু নিয়ে সাধরাণ মানুষের যে আনন্দ-উচ্ছাস সেই সাথে জেলা প্রশাসনও সামিল হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আনন্দ র্যালী, আলোকসজ্জা, ব্যানার, ফেস্টুন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর সাথে সাথে সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বড় পর্দায় সম্প্রসারণেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানান জেলার এই শীর্ষ কর্মকর্তা।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু সুদিন আসবে বাগেরহাটের পর্যটন শিল্প। অপার সম্ভাবনার পদ্মাসেতু নিয়ে স্বপ্ন বুনছে দেশবাসী। স্বপ্ন দেখছে দুই বিশ্ব ঐতিহ্যের জেলা বাগেরহারে মানুষও। সেতু উদ্বোধণের সাথে সাথে বাগেরহাটের পর্যটন শিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে পর্যটন খাতে। কর্মসংস্থান হবে কয়েক হাজার মানুষের। ইনেস্কো ঘোষিত মসজিদের শহর বাগেরহাটের ১৭ স্থাপনা ও সুন্দরবন ঘিরে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান। সেতুর চালুর ফলে দিনে দিনে ঘুরে যাওয়ার সুবিধা সৃষ্টি হওয়ায় দর্শনার্থী বৃদ্ধি পাবে এই অঞ্চলে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন জেলার সরকারি-বেসরকারি পর্যটন খাতের আয় ব্যপ্তি বৃদ্ধি পাবে কয়েকগুণ।
জেলা প্রশাসন ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যের মধ্যে দুটিই অবস্থিত বাগেরহাটে। একদিকে সুন্দরবন অপরদিকে রয়েছে অপরদিকে ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মজসিদসহ ইউনেস্কো ঘোষিত ১৭টি স্থাপনা। ২০২১-২২ অর্থবছরে সুন্দরবনের বাগেরহাট অংশে পর্যটক এসেছেন ১ লক্ষ ২০ হাজার জন। এখান থেকে সরকারের রাজস্ব আয় এসেছে এক কোটি ২৫ লাখ টাকা। একই সময়ে ষাটগম্বুজ মসজিদে এসেছেন ১ লক্ষ ৮০ হাজার দর্শনার্থী। রাজস্ব আয় হয়েছে ৬০ লাখ টাকা। তবে পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে সেই চিরচেনা রুপ একেবারেই পাল্টে যাবে। ঘুরে দাড়াবে সম্ভাবনাময় বাগেরহাটের পর্যটন শিল্প।
স্থানীয় ট্যুরিস্ট গাইড ও ফটোগ্রাফার সোহেল হোসেন বলেন, বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ ও সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। বাগেরহাটে যে পরিমান দর্শনার্থী বর্তমানে ঘুরতে আসে, পদ্মা সেতু হলে এই সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। দর্শনার্থী বাড়লে গাইডের প্রয়োজনীয়তাও বাড়বে। ফলে অনেক বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
ষাটগম্বুজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আক্তারুজ্জামান বাচ্চু বলেন, সেতু চালু হলে বাগেরহাটসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে সমৃদ্ধি ফিরে আসবে। নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বেকারত্ব কমবে। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে অভাবনীয় অগ্রগতি হবে। এখানে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে।
বাগেরহাট প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাস্টোডিয়ান মো. যায়েদ জানান, পদ্মা সেতু যে অমীত সম্ভাবনা দেখাচ্ছে তাতে দর্শনার্থী সংখ্যা ধারনার চেয়েও বেশি হবে। ফলে স্থানীয়রা দর্শনার্থীদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা (হোম স্টে) করতে পারলে বেশ লাভবান হবে। এছাড়া দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে ষাটগম্বুজের সামনের বিশ্রামাগার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি মসজিদ সংলগ্ন ঘোড়াদিঘিকে নান্দনিক করতে ওয়াক ওয়ে তৈরী করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আগত পর্যটকদের সুবিধার্থে পর্যটন করপোরেশনের অর্থায়নে ১২ কোটি ৭৭ লাখ ৬ হাজার টাকা ব্যয়ে খানজাহান আলী (রহ) এর মাজার মোড়ে একটি তিন তারকা মানের হোটেল নির্মাণের কাজ চলছে। যার প্রায় ৮০ ভাগ কাজ ইতমধ্যে শেষ হয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, পদ্মা সেতুর ফলে এই সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে দাবি করেন তিনি। পাশাপাশি সুন্দরবনকে আরও বেশি পর্যটনবান্ধব করে গড়ে তুলতে সুন্দরবনের আলীবান্ধা ও আন্ধারমানিক দুটি পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ কাজ চলছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
পদ্মা সেতু, সংবাদপত্রের জন্য সুখবর, সকালেই হাতে আসবে পত্রিকা। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার পত্রিকা পাঠক ও সংবাদকর্মীদের জন্য সুখবর নিয়ে আসছে পদ্মা সেতু। ঘুম থেকে উঠে পাঠকদের আর অপেক্ষায় থাকতে হবে না পত্রিকার। ২৫ জুনের পরে পাঠকদের সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে পৌছে যাবে জাতীয় সব পত্রিকা। দীর্ঘদিনের বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পাবেন পাঠকরা। সন্ধ্যার পরে ঘটে যাওয়া কোন সংবাদের আপডেট পাঠাতেও কোনো বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না
গণমাধ্যমকর্মীদের। পাঠকরাও ঘুম ভাঙ্গার আগে হাতে পাবেন প্রিয় পত্রিকা। চায়ের কাপে চুমুকের সাথে পত্রিকা পরে খবরের তৃষ্ণা মেটাতে পারবেন পাঠকরা এমনই মনে করছেন বাগেরহাটবাসী।
এস এস সোহান পাঠক জানান, অনেক সময় সকাল গড়িয়ে দুপুর হলেও আমরা পত্রিকা পেতাম না। কিন্তু পদ্মা সেতু হয়ে গেলে চিরতরে সেদিন হারিয়ে যাবে। খুব দ্রুতই আমরা সব খবর জানতে পারব।
হকার মামুন বলেন, ঝড়-বৃষ্টি, জলোচ্ছাস, কুয়াশা, স্রোত বিভিন্ন কারনে পত্রিকা আসতে অনেক দেরি হত। আমরা এজেন্টদের কাছে তীর্থের কাকের মত বসে থাকতাম কখন পত্রিকা আসে। পাঠকরা ফোনের পরে ফোন দিত। অবশেষে সেই চিরায়ত দিনের অবসান হচ্ছে। এখন আর অপেক্ষা করতে হবে না কোনো পাঠককে। ঘুম দিয়ে উঠেই তারা পড়তে পারবেন পত্রিকা।
সংবাদকর্মী আলী আকবর টুটুল বলেন, ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের যেসব পত্রিকা আসে এসব পত্রিকার জন্য আমাদের সন্ধ্যা সাতটার আগেই নিউজ পাঠাতে হতো। কারণ ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে পত্রিকা ছাপিয়ে পাঠানো হতো। যার ফলে সবশেষ আপডেট সংবাদ সম্বলিত পত্রিকা আমরা পেতাম না। এখন যখনই পত্রিকা ছাপানো হোক না কেন, আমরা সকালেই পত্রিকা পাব। এটা ভেবে ভাল লাগছে আমাদের।
বাগেরহাটের পত্রিকা পরিবেশক মোকাদ্দেস আলী জানান, ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রায় সকল পত্রিকা আমরা এনে হকারদের মাধ্যমে বিক্রি করে থাকি। শীতকালে কুয়াশা ও বিভিন্ন সময় দুর্যোগের কারনে পত্রিকা বিকেলে এসে পৌছাত। বিলম্বে আসায় সঠিক সময় পত্রিকা পাঠকদের কাছে পৌছানো সম্ভব হত না। সকালের পত্রিকা অনেক সময় বিকেল বা সন্ধায় দিতে হত। পদ্মা সেতু হলে এই বিড়ম্বনা থেকে আমরা মুক্তি পাব।
বাগেরহাট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক এ্যাড. শাহ আলম টুকু বলেন, একটা সময় ছিল পত্রিকা হাতে পেতাম একদিন পরে। বর্তমানে ফেরী বিড়ম্বনার কারণে প্রায়শই দুপুরের দিকে পাই পত্রিকা। দুপুরে পত্রিকা হাতে পাওয়ার কারণে অনেকে পত্রিকা কিনতে চায় না। পদ্মা সেতু চালু ফেরী বিড়ম্বনা থাকবে না, ঘুম থেকে ওঠার সাথে সাথে পাঠকের বাসায় পত্রিকা পৌছে যাবে। যার ফলে পত্রিকার পাঠকও বাড়বে বলে দাবি করেন তিনি।
কেআই//
আরও পড়ুন