ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪

শনিবারের অপেক্ষায় চা শ্রমিকরা, চলছে কর্মবিরতি

মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ২০:৩২, ২৫ আগস্ট ২০২২

বন ও পরিবেশ মন্ত্রীর আশ্বাস অনুযায়ী আন্দোলনরত চা শ্রমিকদের মজুরির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে শনিবার একটা সিদ্ধান্ত দেয়া হবে। তাই শনিবার পর্যন্ত দেখে নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করবে বলেই জানিয়েছে শ্রমিক নেতারা। একইসঙ্গে তাদের কর্মবিরতি ও আন্দোলন চলবে বলেও জানানো হয়।

বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) বিকেলে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল কালীঘাট চা বাগানে বৈঠক শেষে এমনটাই জানান চা শ্রমিকদের অধিকার আদায় নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া মোহন রবিদাস।

এসময় মৌলভীবাজারের ৯২টি চাবাগান বন্ধ রেখে আন্দোলন চালিয়ে যান চা শ্রমিকরা।

এদিকে, উক্ত বৈঠক শেষে বিভিন্ন নেতাদের আপত্তি সত্ত্বেও ‘চা শ্রমিক অধিকার পরিষদ’ নামে নতুন একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়ে নিজেকে এর আহ্বায়ক হিসেবে ঘোষণা দেন মোহন রবিদাস। 

তার এ ঘোষণায় বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা বলেন, চা শ্রমিকদের অধিকার আদায় নয়, নেতা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর মোহন।

এর আগে বুধবার রাত ১২টার পর মোহন রবিদাস তার ফেসবুক পেইজে লাইভে গিয়ে কালীঘাট চা বাগানে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় বৈঠকে অংশ নেয়ার জন্য সকল পঞ্চায়েত প্রধানদের আমন্ত্রণ জানান এবং বৈঠক শেষে বিকেল ৪টায় প্রেস ব্রিফিং করার কথা বলেন। তবে এ প্রেস ব্রিফিং বা বৈঠকের কোনো আমন্ত্রণ মৌলভীবাজার বা শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি।

বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত সভা করেন তিনি। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মোহন রবিদাস সঙ্গে আরো কয়েকজন চা শ্রমিককে নিয়ে প্রেস বিফ্রিংয়ে আসেন। 

প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, বন ও পরিবেশ মন্ত্রী যেহেতু বলেছেন, শনিবারের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে একটা সিদ্ধান্ত আসবে, তাই আমরা শনিবার পর্যন্ত দেখে নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করবো। তবে আমাদের কর্মবিরতি ও আন্দোলন চলবে।

এ সময় কালিঘাট চা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি অবান তাঁতী,  শ্রমিক নেতা গোপাল রাজভর ও মিন্টু তাঁতী বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার অপেক্ষায় আছি। ঘোষণা পেলে কাজে যাব- মিটিংয়ে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। 

এসময় তাদের কমিটি গঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে গোপাল রাজভর বলেন, কমিটির বিষয়ে আমরা এখন কথা বলবো না। 

এ সময় মোহন রবিদাস বলেন, সকল পঞ্চায়েত প্রধানদের উপস্থিতিতে আমি মোহন রবিদাসকে আহ্বায়ক ও অবান তাঁতীকে সদস্য সচিব করে ‘চা শ্রমিক অধিকার পরিষদ’ গঠন করা হয়েছে। 

তবে, মোহন রবিদাসের এ ঘোষণার সাথে সাথে তার পাশে থাকা মিন্টু তাঁতীসহ আরো দুই চা শ্রমিক বলেন, এমনটা সিদ্ধান্ত হয়নি। কেউ রাজী হয়েছে, কেউ আপত্তি জানিয়েছে। 

এসময় সেখানেই একটা হট্টগোলের সৃষ্টি হয়।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা জানান, আমরা নির্বাচিত চা শ্রমিক ইউনিয়ন। চা শ্রমিকদের মজুরিবৃদ্ধিসহ ২০ দফা দাবী আদায়ে বাংলাদেশীয় চা সংসদের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেছি। ইতিমধ্যে আমরা বেশ কিছু সুবিধা আদায় করেছি। মজুরি নিয়ে আমরা আন্দোলন জোরদার করেছি। মালিক পক্ষ ১২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা পর্যন্ত দিতে রাজী হয়েছে। আমরা তা মানিনি। মানসম্মত মজুরির দাবীতে এখনও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। মধ্যখান থেকে মোহন রবিদাসরা আন্দোলনের নামে নিজের গোপন স্বার্থ চরিতার্থ করছে। 

তিনি বলেন, মোহন রবিদাশের মূল লক্ষ্য শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি নয়, তার চাওয়া নেতা হওয়া।

এদিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মোহন রবিদাস মুঠোফোনে বলেন, মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাকে আহ্বায়ক ও অবান তাঁতীকে সদস্য সচিব, সকল বাগান পঞ্চায়েত সভাপতি-সম্পাদক ও সকল ছাত্র-যুবককে সদস্য করে চা শ্রমিক অধিকার পরিষদ গঠন করা হয়। 

এই কমিটি করার মূল উদ্দেশ্য হিসেবে তিনি বলেন, চা শ্রমিক ইউনিয়নের কোনো নেতা এখন মাঠে নেই। আন্দোলন করছে ছাত্র-যুবকরা। এর একটি ফোরাম প্রয়োজন। তাই এটি করা হয়েছে। 

চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির চুক্তি তাদের সাথে করার জন্য তারা আহ্বান জানাবেন কিনা- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা পরের বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক হলে সেখানে চা শ্রমিক অধিকার পরিষদ থাকতে চায়।

এদিকে বৃহস্পতিবার মৌলভীবাজারে সবকটি বাগানেই কাজ বন্ধ রেখে কর্মবিরতি পালন করছেন চা শ্রমিকরা।  অধিকার আদায়ে বিভিন্ন জায়গায় পালন করা হয় বিভিন্ন কর্মসূচী।

বৃহস্পতিবার সকালে শ্রীমঙ্গল খেজুরীছড়া চা বাগানের নাট মন্দিরের সামনে মজুরি বৃদ্ধি ও অনান্য সুযোগ সুবিধার দাবীতে মানববন্ধন করে চা বাগানের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

মানববন্ধনে শ্রীমঙ্গল রাজঘাট ইউনিয়নের রানার উচ্চ বিদ্যালয় এবং কলেজের প্রায় সহস্রাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেয়। অংশ নেয় খেজুরি ছড়া চা বাগানের প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও কিছু শিক্ষার্থীও।

আন্দোলনে অংশ নেয়া চা শ্রমিক সন্তান কলেজ শিক্ষার্থী সঞ্জিত তাঁতী জানান, তাদের লেখাপড়া করাতে ও অন্যবস্ত্র দিতে তাদের অভিভাবকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। নিজে না খেয়ে অনেক সময় কাজে যান এবং তাদের খেতে দেন। তাদের চোখের সামনে তাদের মা-বাবা অবর্ণনীয় কষ্ট করেন। এর পরিবর্তন তো হওয়া উচিৎ। আর কত কষ্ট করবেন আমাদের মা-বাবারা।

আন্দোলনে অংশ নেয়া অপর শিক্ষার্থী প্রীতি রানী জানান, বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে ১৪৫ টাকা মজুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাস্তবতা নিরিখে যেন তাদের অভিভাবকদের মজুরি বৃদ্ধি করা হয়। 

এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাদের অনেক কিছু দিয়েছেন। এ বিষয়েও যেন একটু সুদৃষ্টি দেন।

এদিকে কাজ না করায় গত বুধবার সাপ্তাহিক তলব (মজুরি) পায়নি শ্রমিকরা। এতে চরম অর্থকষ্টে রয়েছেন শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা। শ্রমিকরা জানান, দ্রুত এর সমাধান করে, মানসম্বত একটা মজুরি দিয়ে তাদের কাজে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়ার।

চা শ্রমিক সন্তান অজিত বুনার্জী জানান, গতকাল বুধবার বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের একদিনের বেতন ও অতিরিক্ত ৫শ টাকা করে আনার জন্য আহ্বান জানায়। কিন্তু আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীরা তা গ্রহন না করতে বলায় কেউই সে টাকা নেয়নি।

এদিকে এই সাপ্তাহে মজুরি না পাওয়ায় অনেক শ্রমিকই সংসার পরিচালনা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। অনেকে আক্ষেপ করে বলছেন, কেউ কি নেই! আমাদের বিষয়টি সমাধান করে দেয়ার।

ফুলছড়া চা বাগানের সাবিত্রী নায়েক জানান, তলব (বেতন) নেই, দোকানদার বাকী দেয় না। আমরা মরে যাই। মরে যাওয়ার পরে কেউ এসে শোক করুক।

এ বিষয়ে সন্তানদের পক্ষে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া মোহন রবিদাস তার ফেসবুক আইডি থেকে লাইভে এসে বলেন, এখন হাজিরা নেই, শ্রমিকদের ঘরে খাবার নেই। তাদেরকে খাওয়ানোর জন্য বাগানের কিছু অবস্থাশালীদের কাছ থেকে বা অন্য যে সকল জায়গা থেকে যথাসম্ভব অর্থ সংগ্রহ করে তাদের খাবার যোগান দিতে ছাত্র যুব সংসদের সদস্যদের আহ্বান জানাচ্ছি। 

তিনি আরও বলেন, চা শ্রমিক ইউনিয়নের ফাণ্ডে শ্রমিকদের লক্ষ লক্ষ টাকা আছে। চা বোর্ডের ফাণ্ড আছে সে সকল জায়গা থেকে তা সংগ্রহ করতে হবে।

এদিকে বেলা ১২টার দিকে শ্রীমঙ্গল কালীঘাট চা বাগানে বেশ কয়েকজন পঞ্চায়েত প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করছেন চা শ্রমিকদের সন্তান ছাত্র-যুবকরা। এছাড়া বিভিন্ন বাগানে পৃথক পৃথক মিছিল করেছেন শ্রমিকরা।

একই সময়ে বালিশিরা ভেলীর ২০টি চা বাগানের পঞ্চায়েত প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করেন শ্রীমঙ্গলস্থ শ্রম অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নাহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের সাথে আলোচনা করেও কিছু ঠিক থাকছে না। এ অবস্থায় করণীয় কি। প্রতি উত্তরে পঞ্চায়েত নেতারা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কোনো ঘোষণা পেলে শ্রমিকরা এই বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা পাবে এবং কাজে যোগ দিবে।

অন্যদিকে বিকেল ৩টায় মৌলভীবাজার শহরের বেরিরপাড় এলাকায় বালিশিরা ভ্যালীর ৫টি চা বাগানের শ্রমিকরা প্রায় দুই ঘণ্টা অবস্থান কর্মসূচী পালন করেন।

এদিকে চা বাগানে প্রতিদিনই কুঁড়ি বড় হয়ে বাড়ছে পাতার সংখ্যা। ধ্বংসের মুখে পড়েছে চা শিল্প। 

বাংলাদেশীয় চা সংসদের সদস্য ও ফিনলে টি কোম্পানীর সিইও তাহসিন আহমদ চৌধুরী জানান, ইতিমধ্যে শত শত কোটি টাকার চা নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি জানান, এ শিল্প অন্য শিল্পের মতো নয়। এটি প্রকৃতি নির্ভর ও পচনশীল। 

এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গলস্থ বিভাগীয় শ্রম অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নাহিদুল ইসলাম জানান, শ্রম দপ্তরের উদ্যোগে নতুন কোনো বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেই। 

তিনি বলেন, আমরা বৈঠক করেছি চা শ্রমিক নেতাদের সাথে। কিন্তু তারা কথা ঠিক রাখছেন না। এখন বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে দেখা হচ্ছে।

এনএস//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি