৮৫ শতাংশ সয়াবিন উৎপাদন হয় যে জেলায়
প্রকাশিত : ১৯:৩২, ১৮ মে ২০১৯ | আপডেট: ২২:৩৭, ১৮ মে ২০১৯
এক সময় লক্ষ্মীপুর জেলার চরাঞ্চলে অনেক খেসারি, মরিচ, বাদাম, তিল, মিষ্টি আলু, তরমুজসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন হতো। মাঠের পর মাঠ এসব শস্যের ফসলে চোখ আটকে যেত। কিন্তু সেই জেলাটি এখন হয়ে পড়েছে প্রায় একক শস্যনির্ভর অঞ্চল হিসেবে।
ভরা মৌসুমে এখন মাঠজুড়ে সয়াবিন ছাড়া অন্য কোনো ফসল তেমন চোখে পড়ে না। দেশে বর্তমানে প্রতি বছর গড়ে এক লাখ ১৫ হাজার থেকে এক লাখ ২০ হাজার টন সয়াবিনের উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদিত এসব সয়াবিনের ৮৫ শতাংশই উৎপাদন হচ্ছে লক্ষ্মীপুর জেলায়। যেই সয়াবিনে ধীরে ধীরে ভাগ্য বদলে যাচ্ছে এই এলাকার মানুষের।
উৎপাদন খরচ কম, ভালো দাম ও ফলন পাওয়ার কারণে জেলার চাষীদের মধ্যে অন্যান্য রবিশস্যের পরিবর্তে সয়াবিন চাষের আগ্রহ বাড়ছে। চলতি মওসুমে জেলায় ৪৫ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কৃষি বিভাগ। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আবাদ হয়েছে ৪৮ হাজার ৫৪৫ হেক্টর জমিতে। প্রতি রবি মৌসুমে মাঠের পর মাঠ সবুজ আবরণে ঘিরে থাকে সয়াবিনের ক্ষেত।
জানা যায়, ১৯৮২ সাল থেকে এ সয়াবিন চাষ শুরু হয় এ জেলায়। সে সময় লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার হায়দারগঞ্জে পরীক্ষামূলকভাবে সয়াবিনের চাষ করে মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি (এমসিসি) নামের একটি সংস্থা। উৎপাদন উপযোগী উর্বর মাটি এবং অনুকূল আবহাওয়ার কারণে পরীক্ষামূলক চাষের প্রথমবারেই এখানে বেশ সাফল্য আসে। পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে সয়াবিনের আবাদ। গত তিন দশকে গোটা দেশের সামনে সয়াবিনকে অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে লক্ষ্মীপুর।
দেশের মোট উৎপাদনের ৮৫ শতাংশই আসে লক্ষ্মীপুর জেলা থেকে। সে সুবাদেই ২০১৬ সালে জেলার ব্র্যান্ড বা পরিচিতি হিসেবে সয়াবিনকে চিহ্নিত করে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসন। লক্ষ্মীপুরকে সয়াল্যান্ড হিসেবে আখ্যা দিয়ে তৈরি করা হয় লোগো ও স্লোগান। জেলাটি পরিচিতি পায় ‘সয়াবিনের লক্ষ্মীপুর’ নামে।
লক্ষ্মীপুর জেলায় সয়াবিনের আবাদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে এখানকার অপ্রতুল সেচ ব্যবস্থারও বড় ভূমিকা রয়েছে। জেলায় সেচের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো প্রায় অনুপস্থিত বলা চলে। অন্যদিকে সয়াবিন আবাদের খুব একটা সেচের প্রয়োজন নেই। ফলে জেলায় শস্যটির আবাদ উপযোগিতা অনেক বেশি। চাষের শুরুর দিকে বৃষ্টি হলে তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও শেষের দিকে বৃষ্টিপাত হলে সয়াবিনের অনেক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সার্বিকভাবে সয়াবিন উৎপাদন লাভজনক। এটি একটি পরিবেশবান্ধব ফসল। এতে সারের পরিমাণ লাগে অনেক কম। আবার সেচেরও প্রয়োজন হয় না। শিম গোত্রের ফসল হওয়ায় সয়াবিনের শিকড়ে নডিউল তৈরি হয়, যা থেকে হেক্টরপ্রতি প্রায় ২৫০ কেজি নাইট্রোজেন (ইউরিয়া সার) সংবন্ধন হয়। এ নাইট্রোজেন সার গাছের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং একটি অংশ মাটিতে যুক্ত হয়ে পরবর্তী ফসলে অবদান রাখে। হেক্টরে সর্বোচ্চ উৎপাদন খরচ পড়ে ২০ হাজার টাকা। ভালো ফসল ও দাম পাওয়া গেলে উৎপাদন খরচের চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি লাভ করা সম্ভব। এ পরিমাণ লাভ অন্য কোনো ফসল আবাদ করে পাওয়া সম্ভব না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সয়াবিন চাষে কৃষকদের সময় লাগে তিন থেকে চার মাস। বয়সভেদে একেকটি সয়াবিন গাছের উচ্চতা দাঁড়ায় ৩০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত। গাছে ফুল ও ফল আসার পর কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষ দিকে এসে সয়াবিনের ক্ষেত থেকে ফসল ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
গত সাত বছরের তথ্য বলছে, লক্ষ্মীপুর জেলার সদর, রায়পুর, রামগতি, কমলনগর, রায়পুর ও রামগঞ্জ উপজেলায় এ সময় মোট ৫ লাখ ৩৪ হাজার ৮৮৩ টন সয়াবিন উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১১-১২ অর্থবছরে জেলায় পণ্যটির আবাদ করা হয় ৩৯ হাজার ১৪০ হেক্টরে। এখান থেকে উৎপাদন হয় ৭৭ হাজার ১০৫ টন। পরের বছর বৃষ্টিজনিত কারণে আবাদ ও উৎপাদন কমে যায়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে জেলার ৪৪ হাজার ৪৮৬ হেক্টর জমি থেকে ৫৭ হাজার ১১৫ টন সয়াবিন উৎপাদন হয়। পরের অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জেলায় আবাদ ও উৎপাদন দুটোই ছিল বাড়তির দিকে। এ সময় এখানে ৪৭ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে মোট ৯৩ হাজার ৬১৭ টন সয়াবিন উৎপাদন হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৯ হাজার ২২০ হেক্টরে উৎপাদন হয় ৯৫ হাজার ৯৮০ টন। এরপর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫২ হাজার ৭২০ হেক্টর জমিতে রেকর্ড ১ লাখ ৩ হাজার ৩০ টন সয়াবিন উৎপাদন হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ঘূর্ণিঝড় ও অতিবৃষ্টির কারণে মাঠেই পানিতে ডুবে পচে নষ্ট হয়ে যায় জেলায় উৎপাদিত সয়াবিনের বেশির ভাগ। ওই বছর ৫০ হাজার ৫০৫ হেক্টর থেকে মাত্র ৩৬ হাজার ২২৬ টন সয়াবিন তুলতে পেরেছিলেন কৃষকরা। ওই বছর মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছিলেন জেলার কৃষকরা। সর্বশেষ গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪১ হাজার ২৭০ হেক্টর জমিতে ফসলটির উৎপাদন দাঁড়ায় ৭১ হাজার ৮১০ টনে। ২০৮-২০১৯ অর্থবছরে আবাদ হয়েছে ৪৮ হাজার ৫৪৫ হেক্টর জমিতে ও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার মেট্রিক টন।
মাঠ থেকে আহরিত সয়াবিন আধুনিক অটোমেটিক মেশিনের মাধ্যমে সিদ্ধ করে শুকানোর পর সয়াবিন তেলবীজ, ডালবীজ ও পোলট্রি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে প্রক্রিয়াজাত হয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। লক্ষ্মীপুরে মূলত তিনটি ব্যক্তি মালিকানাধীন অটো সয়াবিন মিলের মাধ্যমে এখানে উৎপাদিত সয়াবিন প্রক্রিয়াজাত হয়ে থাকে। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুর বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় রয়েছে দুটি। কারখানা দুটি হলো কোয়ালিটি এগ্রো ও চৌধুরী অটো সয়াবিন প্রক্রিয়া কেন্দ্র। বিইউসি এগ্রো লিমিটেড নামে আরেকটি কারখানা জেলা সদরের মজুচৌধুরীর হাট এলাকায় অবস্থিত। এছাড়া এ জেলায় উৎপাদিত সয়াবিন নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর, কুমিল্লার লাকসামসহ বেশ কয়েকটি সয়াবিন প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্রে প্রক্রিয়াকরণ হয়ে থাকে।
স্থানীয় কৃষক আবদুল আলী জানান, সয়াবিন আবাদে খরচ কম। রোগ ও পোকার আক্রমণও কম হয়। চাষাবাদ পদ্ধতি সহজ। বিক্রি করলে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায় ধানের চেয়ে বেশি।
জমির মালিক সুফিয়ান ব্যাপারী ও বর্গাচাষী নাছির উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে চরাঞ্চলে অনেক জমি অনাবাদি পড়ে থাকত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে অনাবাদি জমি পড়ে থাকতে দেখা যায় না। পরিত্যক্ত জমিতেও সয়াবিন চাষে সাফল্য আসছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপসহকারী পরিচালক আবুল হোসেন জানান, সয়াবিন বছরের সব সময় চাষ করা যায়। তবে রবি মওসুমে ফলন বেশি হয়। যে কারণে রবি মওসুমে সয়াবিনের আবাদ হয়ে থাকে। ৯৫ থেকে ১১৫ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা যায়। হেক্টর প্রতি ১.৫ থেকে ২.৫ টন উৎপাদন হয়ে থাকে।
এসএইচ/
আরও পড়ুন