চাঁপাইনবাবগঞ্জে মাদক-বাণিজ্যে সক্রিয় অর্ধশত নারী
প্রকাশিত : ২৩:৫১, ২৯ মে ২০১৯
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরজুড়ে চলছে মাদকের রমরমা ব্যবসা। এর মধ্যে পৌর এলাকার বেশকিছু ওয়ার্ড মাদক ব্যবসার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে চিহ্নিত পুরুষ মাদককারবারিরা আত্মগোপনে থাকলেও শহরজুড়ে নারী মাদক ব্যবসায়ীরা দাপটের সাথে চালিয়ে যাচ্ছে মাদকব্যবসা।
জেলা শহরের একাধিক স্পটে চিহ্নিত নারী মাদক কারবারিরা পুরো পরিবার নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে মাদক ব্যবসা। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মাদকসেবীদের কাছে পাইকারি ও খুচরা মাদক বিক্রিতে মেতে উঠে মাদক ব্যবসায়ীরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদক ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যে বিক্রি করছে হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজা। পুলিশ ও মাদকদ্রব্য দফতরের লোকজনকে ‘ম্যানেজ’ করার নামে সোর্সরা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এসব অঞ্চলে বেশির ভাগ মাদক ব্যবসায়ী চলে ওইসব সোর্সদের সঙ্গে অলিখিত চুক্তির মাধ্যমে। এসব কারণে মাদকের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি শহরের উদয়ন মোড়ের চিহ্নিত এক মাদক কারবারিকে মাদকসহ গ্রেফতার করে সদর থানা পুলিশ। পরে ওই মাদক কারবারি পুলিশের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছে। আর এ কারণেই থানা পুলিশ পালন করছে রহস্যজনক ভূমিকা। সূত্রটি বলছে, নারী মাদক কারবারিরা পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে দাপটের সাথে চালিয়ে যাচ্ছে মাদকের কারবার। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে দাপটের সাথে মাদক ব্যবসা চালাচ্ছে তারা। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশিত মাদকবিরোধী অভিযানে মাদকদ্রব্য আটক করতে গিয়ে উল্টো পুলিশকেই শাস্তির মুখে পড়তে হচ্ছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরসহ আশপাশ এলাকা মিলে প্রায় শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী এজেন্ট দ্বারা মাদকদ্রব্য খুচরা ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করে থাকে। মাদক কারবারিদের সাথে সেবনকারীরা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে থাকেন। সেবনকারীদের চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে মাদক সরবরাহ করে থাকে মাদক ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিরা। অভিনব কৌশলে মাদক সরবরাহ করায় প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের পরেও মাদক বন্ধ হচ্ছে না কোনোভাবেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরে শীর্ষ পর্যায়ের মাদক সম্রাজ্ঞীরা মাদকের আড়তদারি খুলে বসেছে। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তাদের খোলামেলা মাদক-বাণিজ্য চলছে। স্থানীয় মাস্তান, নেতা থেকে শুরু করে মাদক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের বিভিন্ন স্তরে নিয়মিত মাসোয়ারা দিয়েই বহাল থাকছে তাদের আস্তানা। সেখানে একাধারে খুচরা ও পাইকারিভাবে মাদক কেনাবেচা চলে। ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন কী নেই সেখানে? আছে বাংলা মদেরও ছড়াছড়ি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জে অর্ধশত মাদক কেনাবেচার স্পট রয়েছে। শুধু পুরুষ নয়, এখন মাদক-বাণিজ্যে এগিয়ে আছে নারীরা। দাপুটে মাদক সম্রাজ্ঞীরাই চালাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অর্ধশতাধিক মাদক স্পট। তাদের নিয়ন্ত্রণে অন্তত শতাধিক মহিলা এখন পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছে। জেলা শহরের উদয়ন মোড় ও শান্তি মোড় মাদক ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে নিরাপদ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত।
স্থানীয়রা বলছেন জিয়ানগর রেলবাগানের আলোচিত মাদক সম্রাজ্ঞী কারিমা আর রেলস্টেশন বাগানপাড়ার সেলিনা বেগম মাদক সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে। সেলিনা বেগমের নামে বিভিন্ন সময়ে সাতটি মাদক মামলা রয়েছে। কারিমা বেগমের বিরুদ্ধেও দুটি মাদক মামলা রয়েছে। এছাড়া এদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতে জেল-জরিমানাও হয়েছে। আরামবাগের পারভিন, শান্তি মোড় মৃধাাড়ার মর্জিনা, সাবিহা, পপি, ডলিসহ জেলা শহরে অর্ধশত নারী মাদক কেনাবেচার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রধান মাদক স্পটগুলোর মধ্যে মৃধাপাড়া অন্যতম। এখানে রয়েছে মাদকসম্রাজ্ঞী সাবিহা, পপি ও মর্জিনার মাদক স্পট। রামকৃষ্টপুর এলাকাতেও রয়েছে মাদক সম্রাজ্ঞীদের একচ্ছত্র নেটওয়ার্ক। রামকৃষ্টপুরের ‘গেলে’ নামে এক নারী মাদকের কারবার চালাচ্ছে। এদের সাথে পুলিশের সোর্স নামধারী চাঁদাবাজরাও জড়িত। এসব মাদক কারবারিরা বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকও হচ্ছে। তারা জামিনে বেরিয়ে এসে আবারো জড়িয়ে পড়ছে মাদকের কারবারে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানা সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের পাঁচ মাসে ৫ হাজার ৮৪০ পিস ইয়াবা, ১ কেজি ৭ গ্রাম হেরোইন, ১৯ কেজি ৭০০ গ্রাম গাঁজা ও ১ হাজার ১৫৬ লিটার বাংলা মদ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এসব মাদকদ্রব্য উদ্ধারের বিপরীতে মামলা হয়েছে ১৪৩টি। এজাহারে নাম এসেছে ৩৩৭ জন মাদক ব্যবসায়ীর। আর গ্রেফতার হয়েছে ২৯৭ জন।
সোমবার জেলা শহরের উদয়ন মোড়ের কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির আয়োজনে মাদকবিরোধী সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান মিজান। তিনি তার বক্ত্যবে ওই এলাকার জিয়ানগর, রেলস্টেশন বাগানপাড়া, উদয়ন মোড় এলাকায় মাদক ব্যবসা হয় বলে জানান। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ছবি পেছনে রেখে কারা মাদক ব্যবসা করে, মাদকের পৃষ্ঠপোশকতা কারা করে; তাদের ব্যাপারে আমরা কম বেশি সবাই অবগত। দু-চারজন মাদক ব্যবসায়ীর কারণে এলাকার বদনাম হচ্ছে; এটি কাম্য নয়। বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কাজ করছে পুলিশ। তিনি ওই এলাকায় মাদক নির্মূলে থানা পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।
এ ব্যাপারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মো. জিয়াউর রহমান পিপিএম বলেন, মাদকের সন্ধান যেখানেই পাওয়া যাবে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। মাদকের ব্যাপারে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা দরকার। শুধু পুলিশ দিয়ে মাদক ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব নয়। মাদক সমাজের একটি বড় সমস্যা। মাদক ব্যবসায়ীরা সমাজের শত্রু, এদের শনাক্ত করে সামাজিকভাবে বয়কট করা উচিত। সমাজের সব শ্রেণিপেশার মানুষ মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেই মাদক বিষয়ে সরকারে জিরো টলারেন্স বাস্তবায়ন সম্ভব।
আরকে//
আরও পড়ুন