ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

শ্রেণিকক্ষের অভাবে বারান্দায় পাঠ নিচ্ছে আড়াইশ শিক্ষার্থী

দ্বীপ আজাদ, নোয়াখালী

প্রকাশিত : ২০:৪১, ৩১ আগস্ট ২০১৯

একটি মাত্র শ্রেণিকক্ষ হওয়ায় শিক্ষার্থীদের বারান্দা ও সিঁড়িতে বসেই পাঠ নিতে হচ্ছে। আবার বর্ষায় সে ভবন ছুঁয়ে পড়ছে বৃষ্টির পানি। বিদ্যালয়ে নেই সুপেয় খাবার পানির ব্যবস্থা। সামান্য বৃষ্টিতে স্কুলের ছোট মাঠটিতেও জমে কোমর পরিমাণ পানি। এক কথায় বিদ্যালয়টিতে পাঠদানের নূন্যতম পরিবেশও অনুপস্থিত। তারপরও থেমে নেই শিক্ষার্থীদের পাঠদান। যার সফলতা মিলেছে গত আট বছর সমাপনী পরীক্ষায় শতভাগ পাসে। এ চিত্র নোয়াখালীর সদর উপজেলার নেয়াজপুর ইউনিয়নের ধর্মপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। যা জেলা শহরের অদুরেই।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাশাপাশি দুইটি ভবন নিয়েই বিদ্যালয়টি। দুটোই দ্বিতল ভনন। সাইক্লোন শ্লেটারের আদলে নির্মিত ভবন দুটির নিচে ফাঁকা, ওপরে শ্রেণিকক্ষ। একটিতে চারকটি কক্ষ, অপরটিতে দুটি। এর মধ্যে চারকক্ষ বিশিষ্ট ভবনটি ২০১১ সাল থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। তবুও ঝুঁকি নিয়েই পাঠদান অব্যাহত ছিল চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত। অন্য দুই কক্ষ বিশিষ্ট ভবনটির একটিতে শিক্ষকেরা বসেন। আর অপরটিতে শ্রেণিকক্ষ। 
শিক্ষকরা জানান, ওই একটি মাত্র কক্ষই এখন বিদ্যালয়ের ছয়টি শ্রেণির ২২৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য বরাদ্দ। উপায়ন্তু না দেখে পাঁচটি শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয় কক্ষের সামনের বারান্দায়, দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি ও ছাদের সিঁড়ির কক্ষে। এতে পাঠদান দূরের কথা, শিক্ষার্থীদের ঠিকমত বসানোও যায় না বলে উল্লেখ করেন শিক্ষকরা।

তারা আরো বলেন, বর্ষায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়। সামান্য বৃষ্টিতে মোকর সমান পানি জমে বিদ্যালয়ের ছোট্ট মাঠে। এতে শিশু শিক্ষার্থীদের পাহারা দিয়েই শ্রেণি কক্ষে আনতে হয়। কারণ ওই মাঠে একবার কোনো শিক্ষার্থী যদি দৃষ্টির অগোচরে পড়ে যায়, তাহলে তার মৃত্যুও হতে পারে। সামান্য বৃষ্টি হলেই শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিনের সমাবেশ (অ্যাসেম্বলি) করাতে হয় ভবনের নিচের ফাঁকা জায়গায়। 

বিদ্যালয়ের আঙ্গিনা ঘুরে দেখা যায়, সীমানা প্রাচীর নাই। একটি নলকূপ থাকলেও পানি নেই। শিক্ষার্থীরা জানান, বিদ্যালয়ের নলকূপটি অকেজো হওয়ায় তারা পিপাসা পেলে পানি খেতে পারে না। আশেপাশের বাড়িতে গিয়ে পানি খেতে হয় তাদের। 

দেখা যায়, বিদ্যালয়ের যে ভবনটিতে বর্তমানে পাঠদান করা হয় সেটির অবস্থাও অনেকটা নাজুক। ২০১৫ সালে নির্মিত ভবনটির অফিসকক্ষে ছাদ চুইয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে। নিচ তলার মেঝের বিভিন্ন স্থানে দেবে গেছে। সিঁড়ির পাশের দেবে যাওয়া অংশ দেখলে মনে হবে পুরো ভবনই যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে। ওপরে ওঠার সিঁড়ির আস্তর খসে পড়ছে। দ্বিতীয় তলার মেঝেও ছোট ছোট গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। দরজা-জানালাগুলো নড়বড়ে নি¤œমানের। ছাদের অনেক অংশে আস্তর ওঠে গিয়ে গর্তে পরিণত হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিকের জন্য বরাদ্ধ ছাদের সিঁড়ির শেষটুকুর পলেস্তরাও ওঠে গেছে।

পরিদর্শনকালে সিঁড়িতে বসে গণিতের ক্লাসের পাঠ নিচ্ছিল তৃতীয় শ্রেণির রায়হানা বিনতে শাহেদসহ বেশকয়েকজন শিক্ষার্থী। বোর্ডে শিক্ষক কিছু একটা লিখে বুঝিয়ে দিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু তারা তা খাতায় তুলতে পারছে না। কারণ, সিঁড়িতে বসায় সামনে কোনো বেঞ্চ নাই। এভাবে প্রতিদিনই তাদের পাঠ নিতে হয় বলে জানায় এই শিক্ষার্থী।

পাঠদানরত শিক্ষক তপতি রানী দেবি বলেন, বারান্দায় ও সিঁড়িতে শিক্ষার্থীদের বসানোর কারণে পাঠদানের নূন্যতম পরিবেশও নেই। আবার পাশাপাশি দুইটি শ্রেণির পাঠদান করায় শিক্ষার্থীরা শুধু নয়, তাঁরাও মনযোগ ঠিক রাখতে পারেন না। চিৎকার করে করে পাঠদান করাতে গিয়ে অল্পতেই তাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন।

নুর ভানু নামে অপর শিক্ষক জানান, পুরো বর্ষাজুড়েই দুর্ভোগে পোহাতে হয় তাদের। বারান্দায় ক্লাস নেয়া যায় না। বৃষ্টির পানি ছিটকে বান্দায় ডুকে পড়ে। এতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ভিজে যায় তাদের বই, খাতাসহ পাঠ্য সামগ্রী। ভিজতে হয় শিক্ষকদেরও। 
প্রধান শিক্ষক শামীম আরা বেগম বলেন, ২০১১ সালে এ বিদ্যালয়ে যোগদানের পর বিদ্যালয়ের একমাত্র ভবনের অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ দেখে কর্তৃপক্ষকে তখন থেকেই লিখিতভাবে জানিয়ে আসছেন। এ যাবত হিসাবহীনভাবেই লিখে গেছেন এমন দুর্ব্যবস্থার কথা। শুধু লিখেই খ্যন্ত হননি পুরাতন ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের জন্য উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে বারবার গিয়ে দেখা করেছেন, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। এতে বিদ্যালয়ের পাঠদান চালু রাখাই এখন দুরূহ হয়ে পড়েছে। 

তিনি জানান, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই এতদিন বাকি পাঁচটি শ্রেণির পাঠদান করাতেন। কিন্তু একের পর এক ভবনের ছাদের পলেস্তারা খসে পড়তে দেখে গত ১৮ জুন থেকে ওই ভবনে পাঠদান বন্ধ রেখেছেন। এখন ২০১৫ সালে নির্মিত দুই কক্ষের ভবনের একটি অফিস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। আর অন্যটিতে পাঠদান করা হয়।

দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, সিঁড়ি ও বারান্দায় পাঠদানের বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তিনি শিগগিরই বিদ্যালয়টি পরিদর্শনে যাবেন এবং বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনার জন্য যা যা করার তা করবেন।

আরকে//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি