ঢাকা, শুক্রবার   ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পিচ কমিটির চেয়ারম্যান তানভীর সিদ্দিকী দাবড়ে বেড়াচ্ছেন এলাকা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:২২, ৩ অক্টোবর ২০১৯ | আপডেট: ২৩:৪৯, ৩ অক্টোবর ২০১৯

মুক্তিযুদ্ধকালীন পিচ কমিটির চেয়ারম্যান তানভীর সিদ্দিকীর অত্যাচার আর খুনের কথা ভোলেননি গাজীপুরের মানুষ। নতুন করে আবারও সক্রিয় স্বাধীনতাবিরোধী এই চক্রটি। ঘাতকের চেহারা নিয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈর দাবড়ে বেড়াচ্ছে সিদ্দিকীবাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর এলাকা দাবড়ে বেড়ানো তানভীর বাহিনীর এমন কর্মকাণ্ডে ভীত সন্ত্রস্থ গাজীপুরের মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁরা মন্ত্রীর কাছে নালিশও করেছে। স্বাধীনতাযুদ্ধকালীন মুক্তিসেনা হত্যাকারী সিদ্দিকী ও তার বাহিনী নতুন করে মাথা চাড়া দিয়েছে গাজীপুরের কালিয়াকৈরসহ আশপাশের এলাকায়।

স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ হিসেবে স্বীকৃত গাজীপুরের মানুষের কাছে বিশাল এক ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত সিদ্দিকী বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের শুধু সরাসরি বিরোধিতাই করেননি তানভীর বাহিনী। হত্যা করেছে কালিয়াকৈর উপজেলার পূর্বচান্দরার মোহাম্মদ আলী, হাবন আলী, জয়নুদ্দিন, পিয়ার আলী ও আমিতন নেছাসহ অন্যদের। তার প্রত্যক্ষ মদদে আগুন দেয়া হয়েছিল বহু মানুষের ঘরবাড়িতে। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল গাজীপুরসহ আশপাশের জেলা-উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ঘটেছে বহুসংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা। 

এলাকা ঘুরে জানা যায়, ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে পিচ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন তানভীর সিদ্দিকী। জাগ্রত চৌরঙ্গির সঙ্গে যুক্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা জানান, একাত্তরে তানভীরের সহযোগী সিদ্দিক চেয়ারম্যান, তাজু মাস্টার ও সদর আলীসহ অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পরে প্রাণ হারায়। সেসময় পিচ কমিটির চেয়ারম্যান কুখ্যাত রাজাকার তানভীর সিদ্দিকীকেও হত্যার জন্য খুঁজতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু ধূর্ত তানভীর পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। স্বাধীনতার পর তানভীর সিদ্দিকী যুদ্ধাপরাধী হিসাবে গ্রেফতার হয়ে জেলে গেলেও তার পরিবারের সদস্যরা তৎকালীন সরকার ও প্রশাসনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে জেল থেকে বের হন। 

পরে সুযোগ খুঁজতে থাকেন তানভীর ও তার পরিবারের লোকজন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমানের জাগদলে যোগ দিয়ে পুরণো রূপে আবির্ভূত হন তানভীর। পুরস্কারস্বরূপ জিয়াউর রহমান তাঁকে বানিজ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। জিয়াউর রহমানের আমল, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামাতের শাসনামলে তিনি বিভিন্ন অপকর্ম, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মুক্তিযোদ্ধাদের লাঞ্চিত, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে নির্মূলসহ অসংখ্য অপরাধে জড়িত ছিলেন। 

এই সময়ে সংগঠিত করেছেন রাজাকার আলবদর আলশামসদের। এরই জের ধরে বিভিন্ন সময়ে তানভীর সিদ্দিকীর পত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওহাব, গাজী ছামান, আক্তারুজ্জামান, আব্দুর রাজ্জাক, খন্দকার আব্দুস সালাম, প্রফেসর খলিলুর রহমান, হাবিল উদ্দিন সিকদার, প্রফেসর মোয়াজ্জেম হোসেন, গাজীপুর-১ আসনের সাবেক এমপি এডভোকেট রহমত আলী, শাহআলম মাস্টারসহ অসংখ্য জ্ঞানী ও গুণিজন লাঞ্চিত হয়েছেন। তার বাহিনীর ভয়ে এলাকা ছাড়েন আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে।

এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীর পিতা মরহুম চৌধুরী লাবিব উদ্দিন আহমেদ সিদ্দিকীর আদি নিবাস কালিয়াকৈর উপজেলার বলিয়াদি। তিনি বলিয়াদি ওয়াকফ্ স্টেটের তথাকথিত মোতওয়ালি। মুক্তিযুদ্ধের কলঙ্কিত এই রাজাকার পিচ কমিটির চেয়ারম্যান থাকাকালে যেসব অপকর্ম করেছেন, নতুন করে আবারও সেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তানবীর। কারণ তানভীর সিদ্দিকীর বড় ছেলে চৌধুরী ইরাদ আহমেদ সিদ্দিকী বর্তমান সরকার সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে হুমকিধামকি দিয়ে আলোচনার পাত্র হয়েছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে কটুক্তি ও হত্যার হুমকি দিয়েও তিনি আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছেন। কেননা ইরাদের এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে সারাদেশে ৪২টি মামলা হয়। পরে গ্রেফতার হয়ে কারাবরণও করেন। 

বর্তমানে জামিনে বের হয়ে নতুন করে আস্ফালন দেখাচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের উপর। আর এ সবের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, তানভীর সিদ্দিকীর ছোট ছেলে ব্যারিস্টার ইশরাক আহমেদ সিদ্দিকী সুপ্রিম কোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার রাজ্জাকের অন্যতম সহকারি। সবসময় তিনি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক দেশ থেকে পালিয়ে গেলে তাঁর চেম্বারের পুরো দায়িত্ব পান তানভীরপুত্র ইশরাক আহমেদ সিদ্দিকী। 

বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করলে এই চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সম্পূর্ণ আড়ালে চলে যান। আবার সুযোগ বুঝে বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাজীপুর-১ আসনে বিএনপি’র প্রার্থী হিসাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এ্যাড. আ.ক.ম মোজাম্মেল হকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী নয়াপল্টনে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় পার্টি অফিসের দলিল ব্যাংকে জমা দিয়ে কয়েক কোটি টাকা লোন নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন বলে বিএনপির সূত্র নিশ্চিত করেছে। দলের অভ্যন্তরে এই দুর্নীতির কারণে ও যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে তাঁর ছেলের আইনী সহায়তার কারণে বিএনপির একটি অংশের কাছে চরমভাবে নিগৃহিত তানভীর। কারণ তার অপকর্মের জের ধরে বিএনপির পার্টি অফিস এখন নিলামে বিক্রি হওয়ার উপক্রম। দলের সঙ্গে বেইমানির কারণে যুবদলের একটি গ্রুপ তাকে রামধোলাই দেয়ার উদ্যোগও নেয়। পরে সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপে রক্ষা পান তিনি।

প্রতিপক্ষকে মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা, মামলা দিয়ে ঘায়েল করা ছিল তানভীরের অন্যতম অস্ত্র। তার কৃতকর্মের উদাহরণ টানতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, ১৯৮৭ সালে সফিপুরে মোশারফ হোসেন নিহত হলে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও জনপ্রতিনিধিদের ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জড়িয়ে হত্যা মামলা দায়ের করান তানবীর। প্রতিপক্ষকে শারীরিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেন। সেই মামলার চূড়ান্ত নিস্পত্তি এখনো হয়নি। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তিনি বলিয়াদি ওয়াকফ্ স্টেটের বদৌলতে জমি-জমার নামজারি-জমাভাগ খুলে খাজনা আদায় করতেন। এর একটি পয়সাও সরকারকে পরিশোধ না করায় সরকারি তহসিল অফিসে যুগ-যুগ ধরে জমির খাজনা বাকি পরে। পুনরায় জনসাধারণকে তহসিল অফিসে জমির খাজনা প্রদান করতে হয়। এতে জনগন অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ  হন। একই জমি একাধিকবার বিক্রি করা তানভীর সিদ্দিকীর পেশা ও নেশা। এতেকরে অনেক পরিবার তাদের সম্পত্তি হারিয়েছেন, হয়েছেন অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া। 

এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তানভীরের রাজাকারগিরি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে মন্ত্রীর এপিএস বলেন, স্যার দেশের বাইরে আছেন। বিদেশ থেকে ফিরলে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বিপ্লবের স্থান গাজীপুরে কোন যুদ্ধাপরাধীর জায়গা হবে না বলে জানান তিনি। এদিকে তানভীর সিদ্দিকীর পুরণো চেহারায় আবির্ভূত হওয়া নিয়ে আতঙ্কে আছেন গাজীপুরের মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর এলাকায় এখনো কিভাবে পিচ কমিটির চেয়ারম্যান একাত্তরের চিহ্নিত ঘাতক ও দালাল মাস্তানি করে সেটাই মুক্তিযোদ্ধাদের জিজ্ঞাসা। তানভীর সিদ্দিকী কালিয়াকৈর বাজারসহ অসংখ্য ব্যবসায়ী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেছেন। 

প্রাইমারি স্কুলসহ বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি দেয়ার নাম করে তার পিএস আনোয়ারের মাধ্যমে বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে গাজীপুরের আটাবহ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিপক্ষ কাউকে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সুযোগ না দিয়ে তার পছন্দের প্রার্থীকে বন্দুকের নলের মুখে বিনা ভোটে পাস করিয়ে আনেন তিনি। এই চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও তার দুইপুত্র এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন বলে বিএনপির সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এসি

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি