যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল নুসরাতকে
প্রকাশিত : ১০:৫৭, ২৪ অক্টোবর ২০১৯
গত ৬ই এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে। এরপর ১০ এপ্রিল ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় নুসরাত।
এতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াও সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরেই সমালোচনা ওঠে।
আগুন দেয়ার আগে যা ঘটেছিল:
নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সোনাগাজী মডেল থানায় ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানীর অভিযোগ এনেছিল নুসরাত।
গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন নুসরাতের মা শিরিন আক্তার।
এর পরের দিন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দী দেয় নুসরাত জাহান।
যেখানে তিনি বলেন, ২৬ মার্চ তাকে দুই বান্ধবীসহ হুজুর নিজের রুমে ডেকে নেয়। পরে দুই বান্ধবীকে বের করে দেয়ার পর তার সাথে অশালীন আচরণ করে। সেখানে তাকে প্রশ্ন দেয়ার লোভ দেখানো হয়। নুসরাত সেখানে জ্ঞানহীন অবস্থায় বেশ কিছু সময় পড়ে থাকে বলে উল্লেখ করা হয়। এর আগেও ওই অধ্যক্ষ আরো কয়েক ছাত্রীর সাথে অশালীন আচরণের চেষ্টা করেছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
মামলার পরপরই গ্রেফতার করা হয় অভিযুক্ত অধ্যক্ষকে।
নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন- পিবিআইয়ের উপ-মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদারের সাথে কথা বলে জানা যাচ্ছে, নুসরাত হত্যা মামলার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে, শ্লীলতাহানীর অভিযোগে কারাগারে থাকা অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা কারাগারে বসেই নুসরাতকে হত্যার আদেশ দিয়েছিল, এমন অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়।
মিস্টার মজুমদার, এই হত্যাকাণ্ডকে পরিকল্পিত বলেও উল্লেখ করেন।
নুসরাতের গায়ে যেদিন আগুন দেয়া হলো:
নুসরাত হত্যার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দেয়ার আগে এই তদন্তের প্রাপ্ত তথ্য গত ২৮শে মে একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিল পিবিআই।
সেখানে পিবিআই জানায়, ৬ই এপ্রিল সকালে শাহাদত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিন, হাফেজ আব্দুল কাদের মাদ্রাসায় আসে এবং পরিকল্পনা মত যার যার অবস্থানে যায়।
শাহাদত হোসেন পলিথিনে করে আনা কেরোসিন তেল ও অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে থেকে আনা গ্লাস নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেয়।
কামরুন্নাহার মনির তিনটি বোরকা ও চার জোড়া হাত মোজা নিয়ে সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় রাখে।
শাহাদত হোসেন শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের সাড়ে নয়টার দিকে বোরকা ও হাত মোজা পরিধান করে সেখানে অবস্থান নেয়।
নুসরাত পরীক্ষা দিতে এলে পরিকল্পনা মতো উম্মে সুলতানা পপি গিয়ে নুসরাতকে বলেন তার বান্ধবীকে মারধর করা হচ্ছে। একথা শুনে নুসরাত দৌড়ে ছাদে যেতে থাকে।
দ্বিতীয় তলায় পৌঁছালে নুসরাতকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলে ও ভয় দেখায় পপি।
নুসরাত মামলা তুলবে না বলতে বলতে ছাদে উঠলে কামরুন্নাহার মনি, শাহাদত হোসেন শামীম, জোবায়ের ও জাবেদ নুসরাতের পিছনে ছাদে যায়। সেখানে তারা নুসরাতকে একটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বললে নুসরাত অস্বীকৃতি জানায়।
এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শাহাদত হোসেন শামীম বাম হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরে ও পপিকে বলে নুসরাতের বোরকার মধ্য থেকে ওড়না নেয়ার জন্য।
পপি ওড়না নিয়ে জুবায়েরকে দেয়। জুবায়ের এক অংশ দিয়ে পা বাঁধে ও পপি হাত পেছনে বেঁধে ফেলে।
এরপর পপি, মনি ও শাহাদাত তাকে শুইয়ে ফেলে।
পরে তাকে মুখ চেপে ধরে গিঁট দেয়া হয়।
আর জাভেদ কালো পলিথিনে থাকা তেল গ্লাসে করে নিয়ে নুসরাতের শরীরে ঢেলে দেয়।
শামীমের ইঙ্গিতে জুবায়ের তার কাছে থাকা ম্যাচ থেকে আগুন ধরিয়ে দেয়, তারপর সেখান থেকে সবাই চলে যায়।
আদালতে এসব অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছে অভিযুক্তরা।
যেভাবে সরে পড়ে অভিযুক্তরা:
নুসরাত হত্যার যে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দিয়েছিল পিবিআই তার বরাত দিয়ে মিস্টার মজুমদার জানান, আগুন ধরানোর পর শম্পা ও মনি মনের থেকে বের হয়ে পরীক্ষার হলে পরীক্ষায় বসে।
আরেকজন পরীক্ষার্থী জাবেদও পরীক্ষার হলে যায়।
শাহাদত হোসেন শামীমকে বোরকা দিয়ে যায়।
সে মূল গেট দিয়ে বের না হয়ে পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে বাড়িঘরে ঢুকে যায়।
খুনিদের তিনজন পরীক্ষায় ও একজন বোরকা পুকুরে ফেলে বাড়িঘরে ঢুকে যায়।
আর জুবায়ের বোরকা পরে ঘুরে মেইন গেট দিয়ে বের হয়ে পাশে কৃষি ব্যাংকের সিঁড়িতে ওঠে বোরকা পলিথিনে নিয়ে বের হয়ে আসে।
এদিকে গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় নুসরাতকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেখানে নুসরাতকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।
চিকিৎসকরা জানান, আগুনে তার শরীরের কমপক্ষে ৮০% শতাংশই ঝলসে গিয়েছিল।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার অর্থাৎ ১০ এপ্রিল মারা যায় নুসরাত।
এর আগে, ৮ এপ্রিল নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজকে প্রধান আসামি করে আটজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত পরিচয়ের আরও ৪-৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন।
নুসরাতের মৃত্যুর পর এই মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।
আরও পড়ুন