ঢাকা, শুক্রবার   ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

অ্যাকাডেমিক শিক্ষা না থাকলেও দশ উদ্ভাবনের জনক মিজান

বেনাপোল (যশোর) প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ১৩:০৬, ২৮ অক্টোবর ২০১৯ | আপডেট: ১৩:৩১, ২৮ অক্টোবর ২০১৯

ছিলেন মোটর ম্যাকানিক কিন্তু নিজের উদ্ভাবন শক্তি দিয়ে একের পর এক নতুন নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করে হয়ে গেলেন দেশের মধ্যে অন্যতম উদ্ভাবক। একের পর এক উদ্ভাবনে চমকে দিয়েছেন যশোরের মোটরসাইকেল ম্যাকানিক মিজানুর রহমান মিজান। 

মিজানের জন্ম ১৯৭১ সালের ৫ মে যশোরের শার্শা উপজেলার আমতলা গাতিপাড়ার অজপাড়াগাঁয়ে। বাবা আক্কাস আলী ও মা খোদেজা খাতুন বেশ আগেই পরলোক গমন করেছেন। তাদের ৬ সন্তানের মধ্যে মিজান পঞ্চম। বর্তমানে শার্শার শ্যামলাগাছি গ্রামে মিজান বসবাস করেন।

এ মোটরসাইকেল ম্যাকানিকের অ্যাকাডেমিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও আজ সে নিজের আলোয় আলোকিত। নতুন চিন্তা আর চেষ্টায় এখন পর্যন্ত তার আবিষ্কারের সংখ্যা দশ। দারিদ্রতার কারণে ৮-৯ বছর বয়সেই বাবার সহযোগী হিসেবে কাজে নেমে পড়েন মিজান। তার বাবাও ছিলেন একজন ম্যাকানিক। শ্যালো মেশিন মেরামতের কাজ করতেন। পরে নাভারণ বাজারে একটি মোটরসাইকেলের গ্যারেজে কাজ পান তিনি। সেখান থেকেই তার মোটর মেকানিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু। এখন তার শার্শা বাজারে ‘ভাই ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ’ নামে একটি মোটরসাইকেলের গ্যারেজ রয়েছে।

মিজান বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই তার শখ ছিল নতুন কিছু করা, নতুন কিছু জানা। সেই আগ্রহের কারণেই একে একে দশটি জিনিস উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে।’ তার শেষ উদ্ভাবন করা বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে মিজান বলেন, ‘প্রতিনিয়ত শিশুরা পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে বিষয়টি আমাকে দারুন ভাবে পীড়া দেওয়ায় গত তিন বছর ধরে কাজ করে এর একটা সমাধান পেয়েছি। ছোট একটা ‘ডিভাইস’ যদি কোন শিশুর কাছে থাকে তবে ঐ শিশুটি পানিতে পড়ে গেলে তার বাড়িতে থাকা অ্যালামটি বাজতে থাকবে। এতে ঐ  শিশুর পরিবারের লোকজন জানতে পারবে তাদের সন্তানটি পানিতে পড়েছে।” 

মিজান জানান, তার খরচ হয়েছে মাত্র পাঁচ’শ টাকা। এটি তৈরিতে একটি মোবাইল ফোনের ব্যাটারি, একটি অ্যালার্ম ও একটি ডিভাইস ব্যবহার করতে হয়েছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করলে খরচ কমে আসবে বলে জানান মিজান।

মিজান প্রথমে উদ্ভাবন করেন এমন একটি আলগা ইঞ্জিন। যেটিতে একবার জ্বালানি তেল দিয়ে চালু করলে পরে আর জ্বালানি তেল লাগে না। ইঞ্জিনের সৃষ্ট ধোঁয়া থেকে জ্বালানি তৈরি করে নিজে নিজেই ইঞ্জিনটি চলতে সক্ষম। 

দ্বিতীয়টি, স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র। যা বাসা-বাড়ি, কলকারখানা, অফিস-আদালতে আগুন লাগলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি রক্ষার্থে ৫ থেকে ১০ সেকেন্ডের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে আগুন নেভাতে শুরু করে। কোনো জায়গায় আগুন লাগলে যন্ত্রটি তার তাপমাত্রা নির্ণায়ক যন্ত্রের মাধ্যমে আগুনের অবস্থান নিশ্চিত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যালার্ম ও লাইট অন করে দেয়। এরপর পানির পাম্পের সঙ্গে সংযুক্ত পাইপের মাধ্যমে আগুনের অবস্থানে পানি পৌঁছে দেয়। ফলে আগুন নিভে যায়।

মিজান বলেন, ‘স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রটি ২০১৫ সালে যশোরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় প্রদর্শন করা হলে প্রথমস্থান অধিকার করেন। পরে বিভাগীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় প্রথম ও দ্বিতীয়স্থান অধিকার করে। তার তৃতীয় উদ্ভাবন ‘অগ্নিনিরোধ জ্যাকেট’। এ জ্যাকেট পরে আগুনের ভেতরে যে কেউ নিরাপদে কাজ করতে পারবেন। তার চতুর্থ উদ্ভাবন ‘অগ্নিনিরোধক হেলমেট’ এটি ব্যবহার করলে দুর্ঘটনার আগুনে গলার শ্বাসনালী পুড়বে না। তার পঞ্চম উদ্ভাবন প্রতিবন্ধীদের জীবনমান উন্নয়নে ‘মোটরকার’। এটা বিদ্যুৎ বা পেট্রলচালিত।’

কৃষকদের জন্য ‘স্বয়ংক্রিয় সেচযন্ত্র’ তার ষষ্ঠ উদ্ভাবন। বাড়ি বসেই  মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সেচযন্ত্রটি বন্ধ বা চালু করতে পারবেন। দেশীয় প্রযুক্তিতে মিজান তার সপ্তম উদ্ভাবন করেছেন ‘ফ্যামিলি মোটরকার’। এ মোটরকার এলাকার মানুষের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। 

মিজানের অষ্টম উদ্ভাবন ‘পরিবেশ সেফটি যন্ত্র’। এটি পরিবেশ রক্ষার্থে বহুমুখী কাজ করে থাকে। যন্ত্রটি ময়লা পরিষ্কারের কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। হাতের স্পর্শ ছাড়াই এ যন্ত্রটি পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহার হয়। এটি উদ্ভাবনের পর ২০১৬ সালের ৫ জুন জাতীয় পর্যায়ে তিনি পরিবেশ পদক লাভ করেন বলে জানান মিজান।

মিজান জানান, তিনি উপজেলা জেলা বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে এ পর্যন্ত মোট ১৭টি সাফল্য সনদ ছাড়াও অসংখ্য ক্রেস্ট ও সাফল্য পুরস্কার পেয়েছেন। মিজানের আবিষ্কৃত দেশীয় প্রযুক্তির মোটরকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের আওতাভুক্ত হয়েছে। গ্রামীণ স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নে ছোট ছোট অ্যাম্বুলেন্স তৈরি করার পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

মিজান বলেন, ‘আমার স্বপ্ন দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করা। বর্তমানে  দূষিত বায়ু শোধন যন্ত্র উদ্ভাবনের জন্য কাজ করছি। আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায় উদ্ভাবন করা যন্ত্রগুলো বাজারজাত করতে পারছি না। কেউ সহযোগিতায় এগিয়ে এলে কাজটি সম্ভব হবে বলে মনে করেন মিজান।’

এমএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি