শিক্ষার্থীদের রঙ-তুলিতে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ
প্রকাশিত : ২১:৩৪, ৪ ডিসেম্বর ২০১৯
সামিয়া জাহান ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি মহিলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ছোটবেলায় বই পড়ে জেনেছেন ৫২’র ভাষা আন্দোলন ও ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন আর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের কথা শুনেছেন তার পরিবারের কাছ থেকে। এসব শুনে তার কল্পনায় ভেসে উঠেছে বাঙালির আত্মত্যাগের চিত্র। এবার সেই চিত্র স্কুলের দেয়ালে ফুটে উঠছে সামিয়ার রঙ-তুলির আঁচড়ে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত দিবস উপলক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দেয়ালে ৮ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকছেন সামিয়া। তার সঙ্গে ছবি আঁকছে আরও অন্তত ৩০ শিক্ষার্থী। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর শক্ত অবস্থানের কারণে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে পালানোর সময় রাজাকারদের সহায়তায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। সেসময় তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের অধ্যাপক কে. এম লুৎফুর রহমানসহ কারাগারে আটকে রাখা অর্ধশত বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষকে শহরের কুরুলিয়া খালের পাড়ে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে পাক হানাদাররা। শহর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা কলেজের হোস্টেল, অন্নদা স্কুল বোর্ডিং, বাজার ও গুদামসহ বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ করে। পরদিন ৭ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে পাক হানাদার বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ছেড়ে পালাতে থাকে। এর ফলে ৮ ডিসেম্বর বিনা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদ্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে প্রবেশ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে মুক্ত ঘোষণা করে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ‘রঙিন হবে আমাদের স্কুল’ কর্মসূচি হাতে নেয় ‘আমরাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ নামের একটি ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন। গত পাঁচ বছর ধরে চলা এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রতি বছর একটি বিদ্যালয়ের দেয়ালের ব্লকগুলোকে বিজ্ঞাপন মুক্ত করে সেখানে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকার উদ্যোগ নেয় ‘আমরাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া’। এতে করে দেয়ালগুলো যেমন বিজ্ঞাপনমুক্ত হয় তেমনি শিক্ষার্থীরাও জানতে পারে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। সরেজমিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে ছবি আঁকার কর্মযজ্ঞ। বিদ্যালয়ের দেয়ালের অন্তত ৪৫টি ব্লকে আঁকা হচ্ছে ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ, বদ্ধভূমি, সম্মুখযুদ্ধ, ৭১’র চিঠি, গণহত্যা, শরণার্থীসহ মুক্তিযুদ্ধের নানা ছবি। গত ২৮ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই ছবি আঁকার কাজ চলবে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ‘আমরাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ সংগঠনের ডাকে সাড়া দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিশু নাট্যমের সদস্যরা ছবি আঁকার কাজে সহযোগিতা করে আসছে। কলেজছাত্রী সামিয়া জাহান বলেন, ছোটবেলায় স্কুলের বই পড়ে এবং পরিবারের কাছ থেকে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জেনেছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার আগ্রহও অনেক। আমাকে ‘যুদ্ধ চলছে’ এমন একটি ছবি আঁকার জন্য বলা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সেই ছবি এঁকে আমারও অনেক ভালো লাগছে। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস্ স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র আবু সায়েম ভূঁইয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের শরাণার্থীদের একটি ছবি আঁকছি আমি। কখনও ভাবিনি এই ছবি আঁকতে হবে। ছবিটা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছি। এই ছবি আঁকার সুযোগ পেয়ে ভালো লাগছে। ফাল্লাগুনি মলিক নামে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি মহিলা কলেজের আরেক ছাত্রী বলেন, আমি ভাষা আন্দোলনের একটি ছবি আঁকছি। ছবির কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছি। ছবি আঁকতে গিয়ে মনে হচ্ছিল আমিও যদি সেই আন্দোলনে থাকতে পারতাম। এই ছবি আঁকতে পেরে মনে অন্য রকম এক অনুভূতি কাজ করছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোস্তফা কামাল বলেন, স্কুলের দেয়ালে ছবি এঁকে মুক্ত দিবস ও মুক্তিযুদ্ধকেই যেন সামনে নিয়ে এসেছে ‘আমরাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ সংগঠনটি। দেয়ালে খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারছে।
প্রতি বছর ৮ ডিসেম্বর সকাল ৮টা ৮ মিনিটে জেলার ৮ বিশিষ্টজনকে দিয়ে ‘রঙিন হবে আমাদের স্কুল’ কার্যক্রমের উদ্বোধন করানো হয়। এবার এ কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন জেলার ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘আমরাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা বিবর্ধন রায় ইমন বলেন, শিক্ষার্থীদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এ উদ্যোগ। বিদ্যালয়ের দেয়াল রঙিন করে দেয়ার মাধ্যমে আমরা মুক্ত দিবসকে রাঙিয়ে তুলতে চাই। সবাইকে নিয়ে মেতে উঠতে চাই বিজয়ের আনন্দে।
আরকে//
আরও পড়ুন