ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে ইরি চাষ অনিশ্চিত

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ১৮:২৭, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চার উপজেলার ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে ইরি ফসল চাষ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সরকারি সুবিধায় সেচ পাওয়ার পথ রুদ্ধ হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ৩৪ হাজারেরও বেশি কৃষক। পানির জন্যে জমি পতিত পড়ে থাকার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের স্থাপনা নির্মাণ এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সম্প্রসারণ কাজের জন্যে সেচ সুবিধা প্রদানে ব্যবহৃত পুকুর ও সেচ ক্যানেল ভরাট করার উদ্যোগ নেওয়ায় এই সেচ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। 

ইতিমধ্যে বিএডিসি’র কুলিং রিজার্ভার হিসেবে ব্যবহৃত পুকুর ভরাট করে ফেলা হয়েছে। জুন মাস থেকে শুরু হয় ভরাট কাজ। প্রশাসনের বাধার মুখেই চলে ভরাট। জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির একাধিক সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও ভরাট আটকানো যায়নি। পুকুর ভরাট শুরু হওয়ার পরই মানববন্ধন করেছেন এলাকার কৃষকরা। 

আর দু-সপ্তাহ পরেই সেচ কাজে ব্যবহারের জন্যে পানি সরবরাহ করার সময় নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু কুলিং রিজার্ভার হিসেবে ব্যবহৃত পুকুর এখন বিশাল বালির মাঠ।

বিএডিসি সূত্রে জানা যায়, আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কুলিং সিস্টেমে ব্যবহারের জন্যে মেঘনা নদী থেকে উত্তোলিত পানি ব্যবহারের পর তা পুনরায় আবার নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। ১৯৭৫ সালে এলাকার সমাজসেবী মাহবুবুল হুদা ভূঁইয়া ও খোরশেদ সিকদার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের বর্জ্য পানিকে জমিতে সেচের কাজে ব্যবহারের উদ্যোগ নেন।

আর এতে এলাকার জমিতে ইরি চাষে সাফল্য এলে সরকার ১৯৭৮-৭৯ সালে বিএডিসি’র মাধ্যমে এই সেচ সুবিধা আরও সম্প্রসারণ করেন। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া পানিকে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেচ কাজে ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হয়। এজন্য বিভিন্ন সেচ অবকাঠামো নির্মাণ করা ছাড়াও, বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত গরম পানি সরাসরি জমিতে না দিয়ে কুলিং রিজার্ভার রেখে সরবরাহ করা হয়। 

প্রকল্পের শুরু থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একটি পুকুরকে কুলিং রিজার্ভার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ করেই জুন মাসে পুকুরটি ভরাট করতে শুরু করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এরপরই বিষয়টি বিএডিসি’র কর্মকর্তারা জেলা প্রশাসককে অবহিত করেন। 

জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় এ নিয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কয়েকবার সেখানে গিয়ে ভরাট নিষেধ করেন। কিন্তু এসবের মধ্যেই পুকুরটি পুরোপুরি ভরাট করে ফেলা হয়েছে। 

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাশিম জানান, ‘দিন-রাত বালু ফেলে পুকুরটি ভরাট করা হয়েছে। আর এতে চাষাবাদে কি প্রভাব সৃষ্টি হয় আর কদিন পরই তা বুঝা যাবে।’

তিনি বলেন, ‘তারা পুকুরটি ভরাট করেছে এখানে স্থাপনা করার জন্য। কিন্তু এখানে বিদ্যুতের বিশাল টাওয়ার রয়েছে। তারা কিভাবে এখানে স্থাপনা করবে তা আমার বোধগম্য নয়।’

প্রকল্পের প্রধান সেচ খাল হিসেবে ব্যবহার হয় আশুগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশের বরোপিট ক্যানেল। মহাসড়ক প্রশস্তকরণ কাজের জন্যে এই ক্যানেল ভরাট করারও উদ্যোগ রয়েছে। এমনি অবস্থায় দেশে ব্যতিক্রমী এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন এলাকার জমির মালিক ও কৃষকরা।

এই সেচ সুবিধাতে এলাকার ফসল চাষে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছিলো। ইরি ফসলের আবাদ শুরু হয় এই পানির ওপর নির্ভর করেই। বর্তমানে এই সেচ সুবিধা কাজে লাগিয়ে বছরে ৫৬ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন ইরি ধান উৎপন্ন হচ্ছে।

সেচ সুবিধা ভোগ করছেন ৩৪ হাজারেরও বেশি কৃষি পরিবার। গ্রাভিটি ও লিফটিং পদ্ধতিতে প্রতি একরে চারশ’ ও দুইশ’ টাকা সেচকর দিয়ে সেচ সুবিধা পাচ্ছেন তারা। প্রকল্পটি বন্ধ হলে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা কৃষকদের। তাছাড়া খাবার পানির সংকটও দেখা দেবে বলে জানান এলাকার মানুষ। 

শুকুর মাহমুদ নামে এক কৃষক বলেন, ‘আগে বৈশাখ মাসো দুইলা বোরো ধান করতাম। দু-তিন মণ ধান পাইতাম। প্রতিবছর অই অভাব। মাশের-ছোলার ভাত খাই। আর অহন একখানি ক্ষেত ২৫ মণ ধান পাই। থোরা জমিতে ভালো চলে।’চুয়াল্লিাশ বছর ধরে নির্বিঘ্নে ফসল আবাদ করলেও এবার দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন এই কৃষক। 

জামান নামের আরেক কৃষক বলেন, ‘সবুজের পানি বন্ধ হলে আমাদের বিশাল ক্ষতি হবে। বাপ-চাচা ও দাদার আমল থেকে আমরা এই পানি ব্যবহার করে জমি করছি।’ 

এমন অবস্থা শুধু আশুগঞ্জের শুকুর মাহমুদ বা জামানের নয়। আশুগঞ্জ ছাড়াও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর,সরাইল ও নবীনগরের ৩৪ হাজারেরও বেশি কৃষক চিন্তিত সেচের পানি পাওয়া নিয়ে। এসব উপজেলার ২২টি ইউনিয়নের ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়া হয় ওই প্রকল্পের মাধ্যমে। 

আশুগঞ্জ-পলাশ এগ্রো ইরিগেশন প্রকল্প পরিচালক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ওবায়েদ হোসেন বলেন, ‘কুলিং রিজার্ভার না থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে গরম পানি জমিতে দিলে উৎপাদন ভালো হবে না। সে কারণে কুলিং রিজার্ভার খুবই জরুরি। তাছাড়া বোরোপিট ক্যানেল ভরাট করে ফোর লেনের কাজ করা হলে ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান সম্ভব হবে না। এতে ৩৪ হাজারের বেশি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ 

তিনি জানান, ‘এটি সারা দেশের একটি ইউনিক প্রকল্প এবং পরিবেশ বান্ধব। এতে ভূগর্ভস্থ পানি লিফটিং করতে হচ্ছে না। উল্টো আমাদের গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জ হচ্ছে।’ 

তবে বর্তমানে পুকুর ভরাটের কাজ বন্ধ। পুকুরটি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সেখান থেকে বালু সরিয়ে নিবে বলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর বরাদ দিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাজিমুল হায়দার জানিয়েছেন।

এআই/এসি
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি