মোবাইল চুরির অভিযোগে কিশোরকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন
প্রকাশিত : ২০:২৭, ৭ জানুয়ারি ২০২০
মোবাইল চুরির অভিযোগে কিশোরকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন
সুনামগঞ্জের ছাতকে একটি চায়ের দোকান থেকে মোবাইল চুরির অভিযোগে এক কিশোরকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করা হয়েছে। গত (২ জানুয়ারি) বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১০টার দিকে ধারন বাজারের উত্তরে বেত বাগানে ঘটা এ ঘটনায় তোলপাড় চলছে এলাকায়।
গ্রাম্য কবিরাজের কাছে তদবিরের কথা বলে কিশোরকে একটি সিএনজি গাড়িতে তুলে নিয়ে নির্জন একটি মাঠে হাত পা বেঁধে, মুখে কাপড় ঢুকিয়ে পাশবিক নির্যাতন করা হয়। তারপর একটি পরিত্যক্ত কক্ষে কিশোরকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় রেখে যায় দুর্বৃত্তরা।
পরে স্থানীয়রা গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে কৈতক হাসপাতালে প্রেরণ করেন। সেখান থেকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হয়।
নির্যাতিত কিশোরের নাম শামীম আহমদ (১৭)। সে উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ সৈদেরগাঁও ইউনিয়নের ধারন বাজার সংলগ্ন সৈদেরগাঁও গ্রামের আবদুন নূরের ছেলে।
স্থানীয় ও কিশোরের পরিবার সূত্রে জানা যায়, ৩-৪ বছর যাবৎ একই ইউনিয়নের পিরপুর গ্রামের জিল্লু মিয়ার মালিকানাধীন ধারন বাজারস্থ চায়ের দোকানে কাজ করে আসছিল শামীম। গত ৩১ ডিসেম্বর ছোরাব আলী নামের একজনের একটি মোবাইল ওই চায়ের দোকান থেকে চুরি হয়ে যায়।
এ ঘটনায় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ চায়ের দোকানের মালিক জিল্লু মিয়ার নিকট থেকে ১০ হাজার টাকা জামানত নিয়ে গত (৩ জানুয়ারি) শুক্রবার শালিস বৈঠকের তারিখ নির্ধারণ করেন। কিন্ত তার আগের দিন বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১০টার সময় গ্রাম্য কবিরাজের নিকট তদবির করার কথা বলে দোকানের মালিক জিল্লু মিয়ার নির্দেশে কিশোরের পিতা আবদুর নূরের সামনে চায়ের দোকান থেকে কিশোর শামীমকে নিয়ে যান কতিপয় যুবক।
ধারন বাজারের উত্তরে একটি বেত বাগানে নিয়ে কিশোর শামীমের হাত-পা বেঁধে পাশবিক বর্বর নির্যাতন করা হয়। এসময় তার দুটি পা ভেঙ্গে দেয় দুষ্কৃতিকারীরা। নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে শামীম অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তাকে সিএনজিতে তুলে নিয়ে এসে ধারন বাজার সংলগ্ন একটি পরিত্যক্ত কক্ষে ফেলে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা।
চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে উঠে পড়ে লেগেছে একটি বিশেষ মহল। ঘটনার প্রায় একসপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কিশোর শামীমের হতদরিদ্র দিনমজুর পিতা আবদুর নূর থানায় কোনও অভিযোগ দায়ের করেনি।
চায়ের দোকানের মালিক জিল্লু মিয়া দিনমজুর আবদুর নূরের ওপর প্রভাব খাঁটিয়ে বিষয়টি ধামা চাপা দিতে মরিয়া।
দিনমজুরের সন্তান হওয়ায় কিশোর শামীমকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছুদিন যাবার পর বই-খাতা ফেলে দিয়ে নিতে হয় চায়ের দোকানে কাজ। কাজ করে যা বেতন পায় তা দিয়ে তার পিতাকে নানাভাবে সাহায্য করে পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিল ছোট্ট ছেলেটি।
কিন্তু বর্বরদের মধ্যযুগীয় নির্মমতা তার দুটি পা কেড়ে নিতে চলেছে। চোর অপবাদ দিয়ে বর্বর ঘাতকরা হাত-পা বেঁধে, মাথা, নখ ও পিঠে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে পা দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছে। নির্মম নির্যাতনের সময় শামীমের করুণ আর্তচিৎকার মন গলাতে পারেনি দুর্বৃত্তদের। এমনকি এ পৈশাচিক নির্যাতনের সময় দুর্বৃত্তরা ভিডিও চিত্রও ধারণ করেছিল। নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে এক পর্যায়ে স্বীকার করেছিল মোবাইল সে চুরি করেছে। কিন্ত এতেও রেহাই মেলেনি শামীমের। নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও ভয়ে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে নারাজ কিশোর শামীমের পরিবার।
এ বিষয়ে পাশবিক নির্যাতনের শিকার কিশোর শামীমের পিতা আবদুন নূর বলেন, আমি চায়ের দোকানের সামনে একটি সিএনজিতে বসা ছিলাম। আমার ছেলেকে মোল্লার বাড়ি চাল পড়া খাওয়ানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে একটি সিগারেট আমার হাতে দেয়া হয়। তারা বলেন, তুমি সিগারেট টানতে টানতে আমারা ফিরে আসবো। আমি সিগারেটে দুই টান দিয়েছি আর কিছু বলতে পারিনা। সিএনজিতে ঘুমিয়ে পড়ি। মনে হয় সিগারেটে নেশা ছিল।
তিনি আরও বলেন, আমরা অসহায় মানুষ। স্থানীয় গণ্যমান্য মুরব্বিয়ানরা চায়ের দোকানের মালিক জিল্লু মিয়ার নিকট থেকে আগে ১০ হাজার টাকা ও এখন আরও ৫০ হাজার টাকা সিকিউরিটি নিয়েছেন। আজ মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) শালিস বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
চায়ের দোকানের মালিক জিল্লু মিয়া শালিস বৈঠক ও সিকিউরিটি বাবদ মোট ৬০ হাজার টাকা দেয়ার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ঘটনাটি যেভাবে বলা হচ্ছে এই ভাবে নয়।
এ ব্যাপারে ছাতক থানার ওসি মোস্তফা কামাল বলেন, এ ঘটনায় কোনও অভিযোগ পাইনি। লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এনএস/
আরও পড়ুন