ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

জমে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ খেজুর গুড়ের হাট (ভিডিও)

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ১১:৩২, ২৫ জানুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১১:৩২, ২৫ জানুয়ারি ২০২০

শীত এলেই ব্যাপকভাবে জমে ওঠে চুয়াডাঙ্গা জেলার ঐতিহ্যবাহী সরোজগঞ্জ বাজারের খেজুর গুড়ের হাট। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই সরোজগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে গুড়ের ভাড় নিয়ে হাজির হয় গুড় উৎপাদনকারীরা। খেজুর গুড় উৎপাদন ও বিক্রির এখন ভরা মৌসুম। 

স্বাদে ও গন্ধে এখানকার গুড় অতুলনীয়। সেইসঙ্গে নলেন পাটালির খ্যাতি এখনো  কমেনি। তাই এ গুড় কিনতে মানুষের ভিড় চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী সরোজগঞ্জ খেজুর গুড়ের হাটে। তবে অন্যান্য বারের তুলনায় খেজুর গুড়ের চাহিদা বেশি থাকায় দাম বেড়েছে। খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহ করা রস দিয়ে তৈরি ঝোলাগুড় ও নলেন পাটালি বেচা-কেনার জন্য এই হাটের ঐতিহ্য কয়েক’শ বছরের।

সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের সরোজগঞ্জে চুয়াডাঙ্গা-ঢাকা মহাসড়ক ঘেঁষে স্থানীয় সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে প্রতি সোম ও শুক্রবার এ হাট বসে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা।

বাজার কমিটির সভাপতি এম আবদুলল্লাহ শেখ জানান, এখান থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, পাবনাসহ দেশের বড় বড় মোকামে গুড় যায়। প্রতি হাটের দিন গড়ে ২৫০ টন খেজুর গুড় বিক্রি হয়। যার বিক্রয় মূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা। এই মৌসুমে হাটে হাজারো মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবছর শীত মৌসুমে সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেজুর গুড়ের আমদানি এবং বেচাকেনা হয় এই হাটে। স্বাদে ও গন্ধে এখানকার গুড় অতুলনীয়। মৌসুমের প্রায় পুরো সময় জুড়েই হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে জমজমাট থাকে এই হাট। স্থানীয় পাইকার, মহাজন এবং বিভিন্ন মোকাম থেকে আসা ব্যাপারীরা এমনটাই দাবি করেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে সাজানো খেজুর গুড় ভর্তি মাটির কলস ও ছোট ছোট বেতের তৈরি ঝুড়িতে নলেন পাটালি। ক্রেতা-বিক্রেতারা তা দাঁড়িয়ে দেখছেন। দরদাম ঠিক হলে ওজন করে ট্রাকভর্তি করা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ নিজের বাড়ি বা আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠানোর জন্য চাহিদা অনুযায়ী কিনছেন।

হাটের প্রবেশ পথের দুই ধারে বসে কৃষকরা বাড়িতে তৈরি পাটালি বিক্রি করছেন। আর গুড়ের মাতাল করা মিষ্টি ঘ্রাণে মন ভরে যায়। পাটালির টুকরো মুখে পুরতেই স্বাদে ও ঘ্রাণে অন্যরকম এক ভালো লাগায় চোখ বুজে আসে।

পাটালি ব্যবসায়ীরা জানান, মৌসুমের শুরুতেই এ ধরনের পাটালি প্রতি কেজি ১৩০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। এখন আমদানি বেড়ে যাওয়ায় দাম কমেছে। স্বাদ ও ঘ্রাণের কারণে লোভ সামলাতে পারে না অনেকেই।

পাটালির দোকান পার হয়ে ভেতরে যত যাওয়া যায় বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ততই চোখে পড়ে সারি সারি সাজানো গুড়ের কলস। সেইসঙ্গে ক্রেতা-বিক্রেতা ও শ্রমিকদের কর্মযজ্ঞ।

স্থানীয় পাইকাররা বলেন, ‘আগের হাটের তুলনায় গুড়ের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ১২ থেকে ১৪ কেজি ওজনের এক জোড়া গুড়ের কলস ১ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।’

তারা দাবি করেন, ‘সরোজগঞ্জ হাটে বিক্রি হওয়া বেশির ভাগ গুড়ই এলাকার কৃষকেরা বাড়িতে যত্নের সঙ্গে তৈরি করেন। এতে চিনি বা কোনো রাসায়নিক নেই। কিছুটা খয়েরি রঙের হলেও এসব গুড় পুরোটাই খাঁটি।’

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ব্যাপারীরা জানান, ‘দেশের অন্যান্য হাটে এখানকার চেয়ে কম দামে গুড় পাওয়া যায়। তবে সেসব গুড়ে চিনি মেশানো থাকে বলে ব্যবসায়ীরা তা কেনেন না। বেশি দাম জেনেও ব্যাপারীরা ভালো গুড় কিনতে চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জেই ছুটে আসেন।’

এলাকার কয়েকজন গাছি জানান, ‘এবার শুরু থেকেই খেজুর গুড়ের দাম চড়া। জ্বালানি খরচ অনেক বেশি। তাই অনেকে কাঁচা রস ফেরি করে বাজারে বিক্রি করছেন। উৎপাদন ও হাটে আমদানির তুলনায় ক্রেতা বেশি হওয়ায় গুড়ের দাম ঊর্ধ্বমুখী।’

কয়েকজন গুড় বিক্রেতা জানান, ‘গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করা খুব কষ্টের কাজ। এ জন্য অনেকে এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। বর্তমানে খেজুর গাছ ইটভাটায় পোড়ানোর কারণে গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। ফলে গাছিরা রসের অভাবে গুড় তৈরি করতে পারছে না। এ কারণে গুড়ের দাম বেশি।’ 

পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, ‘গত বছরের চেয়ে এ বছর খেজুর গুড়ের দাম বেশি। হাটে আমদানি কম হওয়ায় গুড়ের দাম বেড়েছে।’

বরিশাল থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন জানান, ‘তিনি চুয়াডাঙ্গার খেজুরের গুড় পাইকারি কিনে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করেন। গুড়ের মান ভালো হওয়ায় প্রতি হাটে ২-৪ ট্রাক গুড় কেনেন। তবে গতবারের চেয়ে এবার দাম বেড়েছে।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে বর্তমানে এ জেলায় তিন লাখ ৫০ হাজারের মতো খেজুর গাছ রয়েছে। যার প্রায় অর্ধেকই সদর উপজেলায়।

সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তালহা জুবায়ের মাশরুর জানান, ‘মৌসুমে প্রতিটি গাছ থেকে অন্তত ১০ কেজি গুড় পাওয়া যায়। সে হিসাবে প্রতিবছর  তিন হাজার ৫০০ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদিত হয়। সরোজগঞ্জ হাট খেজুর গুড়ের প্রধান মোকাম। এছাড়া দামুড়হুদা উপজেলার জয়রামপুর ও জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়িয়ায় পাইকারি গুড় বিক্রি হয়ে থাকে। বেসরকারি হিসেবে এই গুড় উৎপাদনের পরিমাণ আরো বেশি।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক  মো. আলী হাসান জানান, ‘চলতি বছর জেলার সাড়ে তিন লক্ষাধিক খেজুরগাছ থেকে প্রায় আড়াই হাজার মেট্রিকটন খেজুরের গুড় উৎপাদন হবে। যা ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে।’ 

সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় চুয়াডাঙ্গার গুড়ের হাটের সুনাম ছড়িয়ে যাবে চারদিকে এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।

এআই/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি