মিস্টার বাংলাদেশ তামীর আনোয়ার
প্রকাশিত : ১৭:০৪, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০
তামীর আনোয়ার। যিনি মিস্টার বাংলাদেশ নামে পরিচিত। ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার নয়নশ্রী ইউনিয়নে উত্তর বাহ্রা গ্রামের মো. ইকলাচ উদ্দিন ও রহিমা বেগম দম্পতির ছোট ছেলে। তার প্রতিভার যোগ্যতা এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দূতি ছড়াচ্ছে। দেশ সেরা এই বডিবিল্ডার আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ছিনিয়ে এনেছেন আন্তর্জাতিক খেতাব। উজ্জ্বল করেছেন দেশের নাম।
অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক মো. ইকলাচ উদ্দিন ও গৃহিনী রহিমা দম্পত্তির ২ ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তামীর আনোয়ারের ছোট বেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি অন্যরকম আকর্ষণ ছিল। তবে অন্যান্য খেলাধুলার চেয়ে বডি বিল্ডিংয়ের প্রতি টান ছিল একটু বেশি। নিজেকে স্মার্ট ও ফিট রাখতে সব সময় পছন্দ করতেন তিনি। শখের বসে বডি বিল্ডিংয়ে নাম লেখালেও এখন এটাকে পেশা হিসেবেই বেছে নিয়েছেন দেশ সেরা এই বডি বিল্ডার।
৪ বার মিস্টার বাংলাদেশ খ্যাতি পাওয়া এই বডি বিল্ডারের যাত্রা শুরু ২০০১ সালে মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজের পড়া অবস্থায়। তখন তিনি এইচএসসির শিক্ষার্থী। ২০০৩ সালে সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অনার্সের ভর্তি হওয়ার পর সেখানেও জিমে ভর্তি হন। ২০০৬ সালে স্বাধীনতা দিবস শরীর গঠন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে চতুর্থ স্থান অর্জন করেন তিনি।
জাতীয় পর্যায় খেলায় ২০০৮ সালে তিনি মিস্টার বাংলাদেশ শরীর গঠন প্রতিযোগিতায় প্রথম অংশগ্রহণ করে পঞ্চম স্থান অর্জন করেন। এরপর মিস্টার বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় ২০০৯, ২০১১ ও ২০১৩ সালেও অংশগ্রহণ করে প্রতিবারই ২য় স্থান অর্জন করেন তিনি।
মূলত ২০১৪ সালের পর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ২০১৪ সালে সাতটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সবগুলোতে প্রথম স্থান অর্জন করেন তামীর। এ সময়ের পর থেকে বডি বিল্ডারের সর্বোচ্চ খেতাব মিস্টার বাংলাদেশ তার দখলে। ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬ সালে টানা তিনবার মিস্টার বাংলাদেশ খেতাব অর্জন করেন তিনি। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে প্রতিযোগিতা বন্ধ ছিল। সবশেষ ২০১৯ সালের প্রতিযোগিতায়ও সব প্রতিযোগিদের পিছনে ছেলে তিনি আবারো মিস্টার বাংলাদেশ খেতাব অর্জন করেন।
দেশের সীমানা পেড়িয়ে বিদেশেও সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন তামীর আনোয়ার। সিংগাপুরের ওয়াল্ড রিজিওনাল চ্যাম্পিয়নশীপের ক্ল্যাসিক ফিজিকস ক্যাটাগরিতে জিতেন ব্রোঞ্জ পদক। এছাড়া ভারতে এ্যামেচার মিস্টার অলিম্পিকে ১২তম স্থান অর্জন করেন।
২০১৯ সালের জুলাই মাসে চিনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান বডিবিল্ডিং অ্যান্ড ফিটনেস চ্যাম্পিয়নশিপে রোপ্য পদ অর্জন করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেন তামীর। এশিয়ান অলিম্পিকে বাংলাদেশি বডি বিল্ডার হিসেবে তিনি প্রথম পদক অর্জন করলেন। এশিয়ান পর্যায়ের টুর্নামেন্টে পদক জয় বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের জন্য বিরল এক ঘটনা। চীনের হার্বিন শহরে অনুষ্ঠিত ক্ল্যাসিক বডিবিল্ডিং অ্যান্ড মেন্স ফিজিকসের ১৭১ সেন্টিমিটার ক্যাটাগরিতে রৌপ্যপদক জেতেন আনোয়ার তামির।
তামীরের সাথে প্রতিবেদকের কথা হয় তার গ্রামের বাড়িতে। তামীর আনোয়ার জানান, ‘আসলে আমি শখেন বসেই বডি বিল্ডিং এ আসি। লেখাপড়া শেষ করার পর ভাল জব করবো এমন ইচ্ছাও ছিল। যেহেতু আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেড়েছি তাই এখন এটাই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি।’
এখন বসুন্ধরার একটি জিমে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘২/৩ বছর আগেও বাংলাদেশে বডি বিল্ডিং এত জনপ্রিয় ছিল না। কিন্ত আমরা যারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করি তারা বেশ কয়েকটি পদক এনে দিয়েছি। এ কারণে বডি বিল্ডিং টা এখন অনেক জনপ্রিয় হয়ে গেছে। আশা করি আগামী কয়েক বছরে আমাদের বডি বিল্ডিং আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে। দেশের যেকোনো শরীর গঠন প্রতিযোগিতায় আমি বাংলাদেশ আনসারের হয়ে অংশগ্রহণ করি।’
যুব সমাজকে মাদক থেকে দূরে রাখতে শরীর চর্চার বিকল্প নেই জানিয়ে তামীর আনোয়ার বলেন, ‘যুবকরা বেশি বেশি শরীর চর্চায় মনোযোগী হলে সমাজ থেকে মাদক দূর হতো। কারণ বর্তমান স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা যেভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে তা অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। কিন্ত এসব বিপথগামী তরুণ ও যুবকের জিমে আনতে পারলে তারা মাদক থেকে দূরে সরে আসত। কারণ যারা নিজের শরীরকে ভালোবাসে তারা মাদক গ্রহণ করবে না।’
বাবা ইকলাচ উদ্দিন গর্বিত ছেলেকে নিয়ে বলেন, ‘আমার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ইচ্ছা ছিল সন্তানরা উচ্চ শিক্ষিত হয়ে ভাল চাকরি করবে। কিন্ত যখন ছোট ছেলে বডি বিল্ডারে নাম লেখালেন দুঃচিন্তায় পড়ে যাই। তামীর মাস্টার্স পাশ করলেও পেশা হিসেবে বডি বিল্ডিংকে বেছে নেওয়ায় ওর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তার নির্ঘুম কেটেছে কত রাত তার হিসাব নেই। তবে ছেলের ইচ্ছা শক্তি ও বড় ছেলের উৎসাহে আনোয়ারের সাফল্য আমাদের দুঃচিন্তাকে স্বপ্নে পরিণত করেছে। ছেলে সমাজে প্রতিষ্ঠিত সবার মতো খুশি আমি। দোয়া করবেন আমার ছেলেটা যেন শুধু বাংলাদেশ নয় সারাবিশ্বে নাম উজ্জ্ব করতে পারেন।’
তামীর আনোয়ারের বডি বিল্ডার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি তামীরের বড় ভাই স্কুল শিক্ষক লুৎফর রহমান। ছোট ভাইয়ের ইচ্ছা শক্তিতে প্রাধ্যান্য দিয়ে সব সময় তার পাশে থাকার চেস্টা করেছেন বলে জানান তিনি।
লুৎফর রহমান বলেন, ‘ছোট বেলা থেকেই তামীর ভাল স্পোটর্স ম্যান ছিল। দৌড়ে সব সময় প্রথম স্থান অধিকার করতো সে। আনোয়ার যখন জিমে ভর্তি হলো আমি ওকে সমর্থন করেছি। কারণ আমি জানতাম ও ওর লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে। অনেকে কটু কথা বলত, তবে আমি আমার ভাইয়ের পক্ষে ছিলাম। আজকে ওর যে প্রাপ্তি এটা ওর কঠোর পরিশ্রমের ফল। আমি ওকে নিয়ে গর্ব করি।’
আর্থিক সহযোগিতা ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বডি বিল্ডারর্সরা নিজেদের যোগ্যতার দ্রুতি ছড়াবেন বিদেশের মাটিতেও এমনটা মনে করেন দেশ সেরা এই বডি বিল্ডারর্স। তার হাত ধরে শুধু বাংলাদেশে নয় সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ুক নবাবগঞ্জের নাম এটাই প্রত্যাশা মিস্টার বাংলাদেশ তামীর আনোয়ারের।
এআই/আরকে
আরও পড়ুন