ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

অযত্ন-অবহেলায় নোয়াখালীর প্রথম শহীদ মিনার

নোয়াখালী প্রতিনিধি 

প্রকাশিত : ১২:২৭, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

চরম অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে  আছে নোয়াখালীর প্রথম শহীদ মিনার। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মরণ করতে বেগমগঞ্জ উপজেলার কাজিরহাট উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কয়েকজন স্কুল পড়ুয়া ছাত্র ও তরুণ মিলে কাঁদামাটি দিয়ে প্রাথমিকভাবে এই শহীদ মিনার স্থাপন করেন। 

পরে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একাধিকবার শহীদ মিনারটির জায়গা পরিবর্তন করে অন্য জায়গায় নির্মাণ করলেও, সংস্কারের কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। 

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির মুক্তির প্রথম আন্দোলন। সে আন্দোলনে নিজের মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে মানুষ বুলেটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই আন্দোলন শুধু ঢাকার রাজপথে সীমাবদ্ধ ছিল না, ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশব্যাপী। নোয়াখালীতে মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে আন্দোলন করেছিল ছাত্র-শিক্ষকসহ সর্বস্তরের জনগণ।

"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি" স্মরণীয় গানটি যখন এদেশের ছাত্র-জনতার মুখে মুখে ব্যাপকভাবে ধ্বনিত হয়নি, তখন শহীদ মিনার স্থাপন ছিল দুঃসাহসিক কর্ম। আইয়ুবি শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জীবনবাজী রেখে সে সময় নোয়াখালী জেলার হাতেগোনা কয়েকজন স্কুল পড়ুয়া ছাত্র ও তরুণ মিলে এক অজপাড়াগাঁয়ে কাদামাটি দিয়ে শহীদ মিনার স্থাপন এবং পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে নোয়াখালীতে প্রথম শহীদ দিবসটি পালন করে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বেগমগঞ্জ হাই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর কয়েকজন ছাত্র ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই-শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’ এ স্লোগান দিয়ে বেগমগঞ্জের কাজিরহাট হাই স্কুলের মাঠে একুশের রাতে জড়ো হয়। বর্তমানে এটি শহীদ আমান উল্লাহ পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত।

তখন তাদের নেতৃত্বে ছিলেন এক সময়ের বৃহ্ত্তর নোয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরে গণতান্ত্রিক কর্মী ও  শিবিরের সভাপতি কমরেড নুরুল হক চৌধুরী মেহেদী। তার সাথে ছিলেন সোনালী ব্যাংকের সাবেক জিএম মরহুম আবদুল জলিল, টিএন্ডটির এসডিই মরহুম মো. হানিফ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা প্রয়াত শান্তিরঞ্জন কর্মকার ও চৌমুহনীর চক্ষু চিকিৎসক মরহুম ডা. আবুল খায়ের প্রমুখ।

তারা সকলে মিলে কাজির হাট হাইস্কুলের মাঠে কাঁদামাটি দিয়ে তৈরি করেন শহীদ মিনার। ঐ রাতে দু-দুবার মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীরা তা ভেঙ্গে ফেলে। তবুও তারা দমেননি। ভোররাতে আবারও শহীদ মিনার বানিয়ে তারা ভাষা শহীদদের স্মরণ করে গাঁদা ফুলের মালা গেঁথে পুষ্পস্তবক অর্পনের মধ্য দিয়ে প্রথম শহীদ দিবস পালন করেছিলেন। এটিই ছিল জেলার প্রথম শহীদ মিনার ও শহীদ দিবস পালন।

এমন ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নোয়াখালীর প্রথম শহীদ মিনারটি এখন পড়ে রয়েছে নানা অযত্ন-অবহেলায়। প্রায় ৬৭ বছর আগে নির্মিত শহীদ মিনারটিকে ঘিরে জেলার অনেক ইতিহাস ঐতিহ্য বহন করলেও এখন কেউ আর সেখানে যায় না। ফলে স্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে বসেছে নোয়াখালীর প্রথম শহীদ মিনারসহ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস।

বিদ্যালয়ের ছাত্ররা আক্ষেপ করে বলেন, ‘অনেকেই জানেন না যে, ভাষা শহীদের স্মরণে নির্মিত এ মিনারটিই জেলার প্রথম মিনার। তাদের দাবি এ মিনারটিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে আবার আগেরমত শ্রদ্ধা নিবেদনের সুযোগ করে দিতে হবে।’

প্রবীণ বাসদ নেতা ও স্থানীয় সাংবাদিক ফারুখ আল ফয়সাল প্রথম শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, ‘সেদিন একুশের রাতে দুইবার মুসলিম লীগের লোকেরা শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে ফেলার পরও কমরেড নুরুল হক চৌধুরী মেহেদীরা থামেননি। স্থানীয় ছাত্র জনতাকে সংঘবদ্ধ করে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তৃতীয়বার শহীদ মিনার স্থাপন করেন। এরপর কয়েক বছর অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি দিবসটি পালন করেছিলেন তারা।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে ১৯৬৯ সালে ইট, সিমেন্ট দিয়ে ঐ শহীদ মিনারটি স্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয়েছিল। বর্তমানে এটি কাজির হাট শহীদ আমান উল্যাহ উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয়েছে।’

জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকা এ শহীদ মিনারটি সংস্কারের দাবি জানিয়ে স্থানীয়রা বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত শহীদ মিনারটি এখন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে এটির দ্রুত সংস্কার করা জরুরি।’

বেগমগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ওমর ফারুখ বাদশা বলেন, ‘ভাষা শহীদেরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা বাংলায় কথা বলতে পারছি। ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে। তাদের স্মরণে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত জেলার প্রথম শহীদ মিনারটিকে সংস্কার করে সেখানেই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা উচিত। তাই, ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত জেলার প্রথম শহীদ মিনারটি সংরক্ষণে দ্রুত সংস্কার কাজ শুরু করা হবে।

নোয়াখালী ৩ (বেগমগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য মামুনুর রশীদ কিরণ বলেন, ‘বেগমগঞ্জের প্রাণকেন্দ্র চৌমুহনীতে নতুন শহীদ মিনার নির্মাণ করলে ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী প্রথম এ শহীদ মিনারটি তার গুরুত্ব হাারিয়ে ফেলে। যার কারণে ইতিহাস ঐতিহ্য বহন করা জেলার প্রথম শহীদ মিনারটি সংস্কার করা হয়েছে কম। তবে জেলার প্রথম শহীদ মিনারটির সংস্কার করা জরুরি। আমরা সেই পদক্ষেপ দ্রুত হাতে নিবো।’

আগামি বছর ২১ ফেব্রুয়ারির আগেই ওই শহীদ মিনারটি সংস্কার করা হবে। পাশাপাশি সেখানে ভাস্কর্য স্থাপন ও ফুলের বাগান তৈরি করে দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি। 

এআই/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি