করোনা সতর্কতায় ২৪ দিন বন্ধ থাকবে বেনাপোল বন্দর
প্রকাশিত : ১৬:৩২, ১ এপ্রিল ২০২০
বাংলাদেশ ও ভারত করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে বিভিন্ন বিধিনিষেধ জারি করেছে। তারই জেরে বন্দর এলাকার অর্থনীতি কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। বেনাপোলে নেই কোন শিল্পকারখানা বেনাপোল স্থল বন্দরের উপরে জীবিকার জন্য নির্ভরশীল কয়েক হাজার মানুষ। এ পথে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকার জেরে রোজগারে টান পড়েছে তাদের। স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল। সেই সাথে বেকার হয়ে পড়েছে বন্দর সংশ্লিষ্ট কয়েক হাজার শ্রমিক। এছাড়া বন্দর ও কাস্টমস সংশ্লিষ্ট কয়েকশত এনজিও কর্মীরাও একই অবস্থায় পড়েছে। ভারত দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সিংহ ভাগ পণ্য আসে এই বন্দর দিয়ে। আপাতত বেনাপোল বন্দরের সঙ্গে যুক্ত সীমান্ত এলাকার মানুষজন করোনা নয় রুজি-রুটি হারানোর ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
গত ২৬ মার্চ থেকে আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশে সাধারন ছুটিতে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছিল। সেটা ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। এর পর ভারতে ২১ দিনের লকডাউন ২৩ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে যা ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে। সেই হিসেবে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ থাকবে আমদানি-রফতানি। পণ্যবাহী ট্রাকের চালক ও হেলপারদের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের জীবানু যাতে এক দেশ থেকে অন্য দেশে বিস্তার করতে না পারে সে লক্ষ্যে বেনাপোল বন্দরের সঙ্গে সব ধরনের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধ করা হয়েছে। করোনা আতংক ও উৎকন্ঠা উদ্বেগের মধ্যে দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে ২৪ দিন কি বন্ধ হয়ে থাকবে আমদানি-রপ্তানি। এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ বন্দর ব্যবহারকারীদের মাঝে।
গত ২২ মার্চ ভারতে জনতার কারফিউ থাকায় বন্ধ থাকে আমদানি-রপ্তানি। এর পর ২৩ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত লকডাউন ঘোষনা দেয় ভারত। এর মধ্যে ২৩ মার্চ রাতে এক ঘোষনায় ২১ দিনের লকডাউন ঘোষনা করা হয়। যে চলবে আগামী ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। সেই হিসেবে ২৪দিন বন্ধ থাকতে পারে বেনাপোল-পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। এর ফলে উভয় সীমান্তে আটকা পড়ে আছে শত শত পণ্যবোঝাই ট্রাক। যার অধিকাংশই বাংলাদেশের শতভাগ রপ্তানিমুখি গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল রয়েছে। যেগুলো বেনাপোল বন্দরে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে। গত ২২ মার্চ থেকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে কোনো পণ্যবাহী ট্রাক বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করেনি। বেনাপোল বন্দর দিয়ে কোনো পণ্য নিয়ে ট্রাক পেট্রাপোল বন্দরে যায়নি। আমদানি-রপ্তানি বন্ধ বাণিজ্যে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও এখন পর্যন্ত তার কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে আর কয়েকদিন বন্ধ থাকলে শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহতের পাশাপাশি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য-সামগ্রীর বাজারে মূল্য বাড়ারও শঙ্কা রয়েছে ব্যবসায়ীদের। প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৩শ‘ থেকে চারশ‘ ট্রাক বিভিন্ন ধরনের পণ্য ভারত থেকে আমদানি হয়। ভারতে রফতানি হয় দেড়শ থেকে দুইশ‘ ট্রাক বাংলাদেশি পণ্য। প্রতিবছর এ বন্দর থেকে সরকার প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা আমদানি পণ্য থেকে ও পাসপোর্টধারী যাত্রীদের কাছ থেকে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়ে থাকে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে লকডাউনের সময় বৃদ্ধি করা হতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। তবে সে ক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানি সাময়িক ভাবে হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
এরই মধ্যে ৩০ মার্চ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ছুটিকালীন সময়ে আমদানিকৃত নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য, জরুরি চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবা সামগ্রী শুল্কায়নসহ খালাস প্রদান এবং রপ্তানিও ইপিজেডের কার্যক্রম সচল রাখার জন্য সকল কাস্টমস হাউস ও শুল্ক স্টেশনসমূহে সীমিত আকারে দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে রাজস্ব প্রশাসন। এতে উল্লেখ করা হয়, অন্যান্য সেবা সামগ্রীর সাথে শিল্পের কাঁচামাল এবং সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার আমদানিও অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে পণ্য খালাসের সাথে বন্দর, ব্যাংক, ট্রান্সপোর্ট ও বন্দর শ্রমিকরা জড়িত রয়েছে। সবার সাথে সমন্বয় করা না হলে কার্যত পণ্য খালাস প্রক্রিয়া কতটুকু সফলতা পাবে সেটাও ভাববার বিষয়।
বেনাপোল স্থলবন্দর হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য সজিব হাসান বলেন, আমরা এখানে কাজ করে যে টাকা পাই তাতে ভাল ভাবে আমাদের সংসার চলে যায়। সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের কারনে সকল প্রকার লোড-আনলোড বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা শ্রমিকসহ সকলে পড়েছি অসুবিধায়। ‘কী ভাবে সংসার চলবে জানি না। কোন উপার্জন নেই এই মুহুর্তে’।
বেনাপোল সিএন্ডএফ এজেন্ট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান বলেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রুখে দিতে দু‘দেশের সীমান্ত বাণিজ্য ২২মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে। সেই সাথে কাস্টমস ও বন্দরে কোন কাজ হচ্ছে না। ফলে আমাদের শত শত সদস্য খুব কস্টের মধ্যে দিনাদিপাত করছে।
পেট্রাপোল সিএন্ডএফ এজেন্ট স্টাফ ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, ‘করোনা সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আগামী ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন ঘোষনা করায় সকল রকম আমদানি-রপ্তানিসহ সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে করোনার আতঙ্কের জেরে স্থল বন্দর এলাকার অর্থনীতি কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে।
বেনাপোল আমদানিকারক সমিতির সহ সভাপতি আমিনুল হক আনু জানান, করোনা ভাইরাস আতঙ্ক এতটাই যে সীমান্ত সীল করে দিয়েছে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে। পাশাপাশি এর প্রভাবও ব্যাবসা বাণিজ্যতে, চরমে পৌঁছবে বলে আমার মত। এখনই ক্ষতির মুখ দেখতে শুরু করেছে ভারত-বাংলাদেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানিকারকেরা। ক্ষতি কাটিয়ে নিতে জরুরী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বড় বাণিজ্যিক সম্পর্ক। আগামী ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ভারতে লকডাউন ঘোষনা করায় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বাণিজ্য বন্ধ থাকলে ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পাশাপাশি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামও বেড়ে যাবে। এনবিআর সম্প্রতি সীমিত আকারে কাস্টমস হাউজ খোলা রেখে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য শুল্কায়নসহ খালাস প্রদান এবং রপ্তানির নির্দেশ দিয়েছেন। তবে পণ্য খালাসের সাথে বন্দর, ব্যাংক, ট্রান্সপোর্ট ও বন্দর শ্রমিকরা জড়িত রয়েছে। সবার সাথে সমন্বয় করা না হলে কার্যত পণ্য খালাস প্রক্রিয়া কতটুকু সফলতা পাবে সেটাও ভাববার বিষয় বলে তিনি জানান।
বেনাপোল স্থলবন্দরের উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবির তরফদার বলেন, প্রতিদিন পেট্রাপোল বন্দর থেকে তিনশ থেকে চারশ ট্রাক আমদানি পণ্য নিয়ে বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করে। আবার বেনাপোল দিয়ে দেড়শ থেকে আড়াইশ ট্রাক রপ্তানি পণ্যচালান যায় ভারতে। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে দুই দেশের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমদানি-রপ্তানির পাশাপাশি বন্দরের সকল কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
বেনাপোল কাস্টমস হাউজের সহকারী কমিশনার উত্তম চাকমা জানান, করোনাভাইরাসের প্রভাব বিস্তার রোধে দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে। কবে নাগাদ চালু হবে সেটা বলা যাচ্ছে না। বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
আরকে//
আরও পড়ুন