বিপাকে বাউফলের হাজারোর্ধ মৃৎশিল্প কারিগর
প্রকাশিত : ১৭:১২, ১৩ এপ্রিল ২০২০
ছাঁচদানির চাকা ঘুরছে না। রঙ তুলির ছোঁয়াও নেই। ভাটির (আগুনে পোড়ানোর চুলা) আগুন বন্ধ হয়েছে আরো আগে। প্রস্তুতিও নেই বৈশাখী মেলায় শোপিচ, খেলনা সামগ্রিসহ নানা সব মাটির তৈজসপত্র বিক্রির। ধোয়া-মোছা কিংবা প্যাকেজিংয়ের টুং টাং শব্দটুকুও না থাকায় সুনশান শান্ত পটুয়াখালীর বাউফলের কাগুজিপুলের পালপাড়া।
জানা গেছে, বৈশাখি মেলা না থাকায় বন্ধ রয়েছে পালপাড়ার ঐতিয্যবাহি মৃৎশিল্প কারখানাগুলো। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখকে ঘিরে এ সময় হাতের কারুকার্যে কাদামাটি দিয়ে তৈরী বাহারি সব পন্যসামগ্রি তৈরী, ডিজাইন, রোদে শুকানো, রঙ করা আর প্যাকেজিং শেষে চলতো কেবল নির্ধারিত বাজারে পৌঁছানো কাজ। কিন্তু করোনার প্রভাবে বৈশাখী মেলার অর্ডার বাতিল হওয়ায় ছোট বড় মিলে সেখানে ১৫-২০ টি মৃত শিল্প কারখানায় জড়িতদের ব্যস্ততার পরিবর্তে সেখানে এখন কেবল মানবেতর জীবনযাপন। সরেজমিন কারখানার আগুনে পোড়ানো ভাটির ছাইগন্ধ আর অলস ছাঁচদানির পাশে পরে থাকা ভেকুয়াপাক যন্ত্রে চটকানো মাটিসহ উঠোনের রোদে পড়ে থাকা কাঁচা মাটির তৈজসপত্রই একুশে টেলিভিশনের চোখে পড়ে।
আজীবন সম্মাননা পাওয়া মৃৎশিল্পী ‘বিশেশ্বর মৃৎশিল্প’ কারখানার মালিক বিশেশ্বর পাল একুশে টেলিভিশনকে জানান, জালের কাঠি, পুতুল, কলস, বাচ্চাদের খেলনা, রসের হাঁড়ি তৈরীর মতো হারিয়ে যাওয়া বাপ-দাদার পেশাকে পরিশ্রমের মাধ্যমে সমপোযোগী বিশ্বমানের আধুনিক পন্যের রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন মৃৎশিল্পীরা। এশিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়াতেও ছড়িয়ে পড়েছে এখানকার তৈরী পন্য। কিন্তু করোনার প্রভাবে এখন থমকে বসেছে এই মৃৎশিল্প কারখানার মালিক ও শ্রমিকরা। কারখানার বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন স্থানীয় প্রায় হাজার খানেক শ্রমিক। এসব শ্রমিকদের শৈল্পিক হাতের ছোঁয়ায় তার কারখানাসহ পাশের বরুন পাল, কালা চাঁদ পাল, বিমল পাল, অনীল পাল, রিনা রাণী, লক্ষ্মী রাণীর কারখানার মাটি শিল্প জয় করে নিয়েছে আড়ং, কারিতাসের প্রকল্প কোড় দি জুট ওয়ার্কস, ঢাকা হ্যান্ডিক্রাফটস, হিট হ্যান্ডিক্রাফটসসহ দেশি বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে। পহেলা বৈশাখকে ঘিরে এসব প্রতিষ্ঠানের তাগিদে খারখানাগুলোর শিল্পী ও শ্রমিকদের নিতে হতো বাড়তি চাপ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ স্থানীয় গ্রামীন মেলা উপলক্ষে পুতুল, ঘোড়া, হাতি, টিয়াসহ মাটির তৈরী বিভিন্ন খেলনারও ছিলো চাহিদা। পহেলা বৈশাখের এসব মেলার আয়োজন বন্ধ হওয়া আর ঢাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্ডার বাতিল করায় কারিগররা এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছে। নেই কোন ব্যস্ততা। উপরন্তু শ্রমিকদের অনেকেই করছেন মানবেতর জীবন যাপন।
তিনি বলেন, ‘প্রতিবছরের ন্যায় পন্যের ডিজাইন পরির্বতণ হয়ে এবছর প্লেট, গ্লাস, মগ, কারিবল, জগ, লবনবাটি, শানকি (বাসন), কাপ-পিরিচ, তরকারির বাটি, ডিনার সেট, সুপসেট, কয়েলদানি, মোমদানি, ঘটি, ফুলদানি, পুতুল, শোপিচ, খেলনাসহ দেশের কয়েকটি জেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ লক্ষ টাকার মতো ওয়ার্ডার পাই। কারখানায় অর্ধেক পরিমান এসব মালামাল তৈরীর পর ডেলিভারির প্রস্তুতির নিলে করোনার প্রভাবে ওর্ডার বাতিল করা হয়। ওয়ার্ডার বাতিল হয় বরুন পাল, কালা চাঁদ পাল, বিমল পাল, অনীল পাল, বিষ্ঞু পাল, শ্যামল পাল, কমল পাল, মানিক পালসহ আরো কয়েক জনের।’
প্রীতম মৃৎশিল্প কারখানার চম্পা, হোসনেয়ারা, সাধনা রানীসহ কয়েকজন শ্রমিক জানান, এখানকার কারখানাগুলো ঘিরে নারীর কর্মসংস্থান ও আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে। তাদের সন্তানরা লেখাপড়া করছে। শ্রমিক ও কারিগররা কৌশলী হওয়ায় বাজার টিকিয়ে রেখে পোড়ামাটির শিল্প সিরামিকস কে চ্যালেঞ্জ করে টিকে রয়েছে। কিন্তু এখন কাজ না থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছে রোজ আয়ে নিযুক্ত বিভিন্ন কারখানার প্রায় হাজার খানেক শ্রমিক। করোনার মতো বৈশ^য়িক বিপর্যয়ে সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছেন তারা। অনেকের দু’বেলা খাবার জোটানোই দায় হয়েছে। করোনার প্রভাবে এবার পহেলা বৈশাখের মেলা বন্ধ হয়ে তৈজসপত্রে রঙ-তুলীর ছোঁয়া না লাগায় রুটিরোজগারেও বিরুপ প্রভাব পড়েছে পালপাড়ার এসব শ্রমিকদের।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, ‘করোনায় বৈশাখী উৎসব বন্ধ হওয়ায় বাউফলের ঐতিয্যবাহি কাগুজিরপুলের পালপাড়ার মৃৎশিল্পে প্রভাব পড়েছে। তবে কোন মানুষই অভূক্ত থাকতে পাড়ে না। মৃৎশিল্প কারখানার মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে শ্রমিকদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।’
আরকে//
আরও পড়ুন