ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

নাটোরে লিচু নিয়ে দুশ্চিন্তায় চাষিরা

নাটোর প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ১৫:২৭, ১১ মে ২০২০

নাটোরের লিচু গ্রাম খ্যাত গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর এলাকায় এবারও উৎপাদন ভাল হলেও চাষিদের মুখে হাসি নেই। 

মৌসুম শুরু আগে থেকেই এলাকায় পাইকার আর ব্যবসায়ীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে থাকতো এখানকার লিচু মোকামগুলো। ইতিমধ্যে স্থানীয় প্রশাসন ২১ মে থেকে নিরাপদ লিচু আহরণের সময়ও নির্ধারষ করে দিয়েছে। তবুও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন এলাকার সহস্রাধিক লিচু চাষি ও ব্যবসায়ীরা। 

দুয়ারে কড়া নাড়ছে মধুমাস জ্যৈষ্ঠ। সপ্তাহখানেক পরই লিচু উঠবে বাজারে। অথচ করোনা পরিস্থিতির কারণে আগাম দিয়ে আড়ত থেকে লিচু বায়না করতে এখনো পাইকাররা আসা শুরু করেনি। উল্টো আগাম দিয়ে বায়না করা বাগান ফেরত দিয়ে টাকা নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। 

ক্ষুদ্র, বাণিজ্যিক ভিত্তিক লিচু উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা কার কাছে লিচু বিক্রি করবেন, সে হিসেব মেলাতে পারছেন না। নাজিরপুর কানুর বটতলার মোকামে কোন প্রাণ চাঞ্চল্য নেই করোনার প্রভাবে।

জেলার সর্ববৃহৎ কানুর বটতলার ব্যবসায়ীরা জানান, ‘জ্যৈষ্ঠের  প্রথম বা শেষ তিন সপ্তাহ এখানে লিচুর মৌসুম হিসেবে বিবেচিত হয়। এই সময় প্রতিদিন শতাধিক ট্রাক লিচু এখান থেকে সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। প্রতি ট্রাকে প্রায় ৫ লাখ টাকার লিচু থাকে। সে হিসেবে তিন সপ্তাহের মৌসুমে গড়ে ১০ কোটি টাকার লিচু শুধু এই মোকাম থেকেই কেনাবেচা হয়। গোটা গুরুদাসপুর উপজেলায় এমন মোকাম রয়েছে আরো ১০টি। সব মিলিয়ে গুরুদাসপুর থেকেই প্রতি মৌসুমে শতকোটি টাকার লিচু কেনাবেচা হয়।’

লিচু বাগান মালিকরা শঙ্কা প্রকাশ করে জানান, বিগত বছরগুলোর তুলনায় ফলন ভালো হলেও এবার ক্রেতা নেই। লিচুর ফুল আসা শুরুর পর অনেক বাগান কেনাবেচা হয়েছে। তবে করোনার কারণে লকডাউন শুরুর পর লিচু বিক্রির অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এতে করে ব্যবসায়ী বা পাইকারদের অনেকেই বাগান কেনার পর  আগাম টাকা ফেরত নিয়েছেন। বাগান ফেরত দিয়ে বিপাকে পড়েছেন মালিকরা।

বাগান আগাম নেয়া ব্যবসায়ীরাই লিচুর বাজারজাতকরণ সম্পর্কে প্রকৃত ওয়াকিবহাল। তারা আগাম দিয়ে বাগান কেনার পর টাকা ফেরত নেয়ায় দুঃশ্চিাতায় পড়েছেন এসব বাগান মালিকরা। তাদের শঙ্কা এবার বিপুল পরিমাণ লিচু বিক্রি নিয়ে তাদের বেগ পেতে হবে। এছাড়া এবার লিচুর কাঙ্খিত দাম ও বিক্রি নিয়েও রয়েছে শঙ্কা।

নাজিরপুরের লিচু চাষি শাহাদত হোসেন জানান, ‘প্রায় ২৫ বিঘার ৮টা বাগান ইজারা নিয়েছি। যেখানে ৫০০টির মতো লিচু গাছ রয়েছে। বাগান প্রতি ইজারা ব্যয় ও কীটনাশকসহ আনুষাঙ্গিক ব্যয় বাবদ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও ফলন ভালো। ইতোমধ্যে কিছু গাছে লিচু পাকতে শুরু করেছে। কিন্তু এবার ঢাকার পাইকরারা আসবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।’

আশরাফুল ইসলাম নামে আরেক চাষি বলেন, ‘লকডাউনের আগে অগ্রিম দিয়ে বাইরের এক পাইকার তাদের একটি বাগান ইজারা নেন। তবে লকডাউনের কারণে অগ্রিম দেয়া অর্থ ফেরত নিয়ে গেছেন। এখন বাগানভর্তি লিচু নিয়ে বিপদে রয়েছি। যারা নিয়মিত ব্যবসায়ী তারা জানেন লিচুর বাজার সম্পর্কে, যা আমার জানার কথা নয়। এখন লিচু কিভাবে বিক্রি করবো সেটাই ভাবছি।’

চাঁচকৈড় বাজারের লিচু ব্যবসায়ী ফয়সাল ‘বাইরের ক্রেতা নির্ভর আমাদের লিচুর বাজার। করোনার কারণে অন্য জেলা থেকে মহাজন, ব্যাপারী ও ফরিয়ারা এবার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। তাই আমরাও বাগান নেয়া বা চাষিদের সাথে কোনো চুক্তিতে আসতে পারছি না। এবার প্রায় বাগানেই ফলন ভালো হওয়ায় ন্যায্যমূল্য পাওয়া  নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে।’

গুরুদাসপুরের আড়তদার ও লিচু চাষি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘লিচু বাজারজাতকরণ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এমনিতেও পচনশীল হওয়ায় লিচুতে সবসময় ঝুঁকি থাকে। এবার অন্যবারের তুলনায় ঝুঁকি কয়েকগুণ বেশি। লিচু আহরণ ও বাজারজাতকরণের সাথে জড়িত ১০ হাজার শ্রমিক কর্মচারী বেকার হয়ে পড়েছেন। লিচুর কোটি টাকার ব্যবসা এবার অনিশ্চিত হয়ে দেখা দিয়েছে।’
  
গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার তমাল হোসেন বলেন, ‘গুরুদাসপুরে উৎপাদিত লিচু বাজারজাতকরণের যে সব সমস্য রয়েছে তা পূরণ করতে স্থানীয় কৃষিবিভাগসহ উপজেলা প্রশাসন সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে দেখছে। ইতিমধ্যে স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ বাগান মালিকদের সাথে বৈঠক করে তাদের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য বিধি মেনে শ্রমিক আনায়নসহ পরিবহনে সবধরনের সহযোগিতা করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিধি মেনে যে সব শ্রমিক কাজ করবে তাদের খাদ্য সহায়তা দেয়া হবে। বাহিরের ব্যবসায়ীদের সাথে প্রয়োজনে কথা বলা হবে। ইতিমধ্যে কৃষিবিভাগের ব্লক সুপার ভাইজার ও স্বেসেবকদের কাজে লাগানো হয়েছে। আশা করছি কোন ধরনের সমস্যা হবেনা এবং চাষিদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। প্রশাসন তাদের পাশে রয়েছে।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সুব্রত কুমার সরকার এ প্রতিবেদককে জানান, ‘চলতি মৌসুমে জেলায় ৯১৩ হেক্টর বাগানে লিচু চাষ হয়েছে। এ থেকে সাড়ে ৮ হাজার টন লিচু উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। শুধু গুরুদাসপুরেই ৪১০ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়েছে। যা থেকে ৩ হাজার ৬৯০ টন লিচুর উৎপাদন হবে।’

জেলা প্রশাসক মো. শাহরিয়াজ বলেন, ‘লিচু আহরণের সময়সীমা আমরা নির্ধারণ করে দিয়েছি। কিন্তু বাজার সৃষ্টি করতে হবে  চাষিদের। তারা চাইলে বাজারজাতকরণে সহযোগিতা করবে প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ।’

এআই//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি