সোনালী আঁশের সুদিন ফেরানোর স্বপ্নদ্রষ্টা যিনি
প্রকাশিত : ১৯:১৪, ৬ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ২০:১৭, ৬ মার্চ ২০১৮
পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে সোনালী আঁশের সুদিন ফেরানোর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম। বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় ২০১০ সালে তরুণ একদল বিজ্ঞানীকে নিয়ে তোষা পাটের জিন নকশা উন্মোচন করে আলোচনায় আসেন মাকসুদুল আলম। ওই বছর ১৬ জুন জাতীয় সংসদে দেশবাসীকে সেই সুখবর জানানো হয়। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের অসামান্য এ সাফল্যের খবর সংসদে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জিনোম হলো প্রাণী বা উদ্ভিদের জিনেটিক বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস বা নকশা। এই নকশার ওপরই নির্ভর করবে ওই প্রাণী বা উদ্ভিদের বৈশিষ্ট। গবেষণাগারে এই জিনবিন্যাস অদল বদল করে উন্নত জাতের পাট উদ্ভাবন সম্ভব। পাটের এ গুরুত্বপূর্ণ অর্জন যিনি করেছিলেন। তিনি আজ আমাদের মাঝ নেই। বাংলাদেশ সময় ২১ ডিসেম্বর ২০১৪ ভোরে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ের কুইন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাকসুদুলের মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। মাকসুদুল লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন। শেষ দিকে লিভারের সঙ্গে তার ফুসফুসও ঠিকমতো কাজ করছিল না।
ম্যানোয়ার ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ের অধীনে কলেজ অব ন্যাচারাল সায়েন্সেসে জিনোমিক্স, প্রোটিওমিক্স ও বায়োইনফরমেটিকস বিভাগের পরিচালক পদে কাজ করে আসছিলেন তিনি। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী হাওয়াই মেমোরিয়াল পার্ক সিমেট্রিতে মাকসুদুলকে দাফন করা হবে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। মাকসুদুল আলমের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেন।
মাকসুদুলের কাছ থেকে বাংলাদেশ আরো একটি সুখব পায়।মাকসুদুল ও তার সহকর্মীদের পরের সাফল্যের খবরটিও আসে প্রধানমন্ত্রীর মুখ দিয়েই। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তিনি জানান, মাকসুদুল ম্যাক্রোফমিনা ফাসিওলিনা নামের এক ছত্রাকের জিন-নকশা উন্মোচন করেছেন, যা পাটসহ প্রায় ৫০০ উদ্ভিদের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা দেয়।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পাটের জিন-নকশা উন্মোচনের ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রয়োজন অনুযায়ী পাটের নতুন জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি পাটের গুণগত মান ও উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বাড়ানো সম্ভব। আর নতুন জাত উদ্ভাবন করা হলে পাট পচাতে কম লাগবে, আঁশ দিয়ে জৈব জ্বালানি ও ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের এই গবেষক এর আগে ২০০৮ সালে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে পেঁপে এবং মালয়েশিয়া সরকারের হয়ে রবার গাছের জীবনরহস্য উন্মোচনেও নেতৃত্ব দেন। পেঁপে নিয়ে তার কাজের খবর বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হয়। ওই প্রতিবেদনে মাকসুদুলকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় ‘বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবক’ হিসাবে।
১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর ফরিদপুরে জন্ম নেওয়া মাকসুদুল আলমের বাবা দলিলউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (বর্তমান বিজিবি) একজন কর্মকর্তা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হন তিনি। স্বামীকে হারিয়ে চার ছেলে ও চার মেয়েকে নিয়ে কঠিন সংগ্রামে পড়তে হয় মাকসুদুলের মা লিরিয়ান আহমেদকে। তবে তার চেষ্টায় ছেলেমেয়েরা পরে যার যার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে মাকসুদুল রাশিয়া চলে যান। ১৯৭৯ সালে মস্কো স্টেইট ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি অণুপ্রাণবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান। ১৯৮২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অণুপ্রাণবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন মাকসুদুল। এর পাঁচ বছর পর জার্মানির ম্যাক্স-প্লাংক ইনস্টিটিউট অব বায়োকেমিস্ট্রি থেকে প্রাণরসায়নেও তিনি পিএইচডি করেন।
ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াইয়ে যোগ দেওয়ার আগে মস্কো স্টেইট ইউনিভার্সিটি, রাশিয়ার বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি, ম্যাক্স-প্লাংক ইনস্টিটিউট এবং ওয়াশিংটন স্টেইট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা ও গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি। অণুপ্রাণবিজ্ঞানের গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯৭ সালে এনআইএইচ শ্যানান অ্যাওয়ার্ড পান মাকসুদুল। ২০০১ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোর্ড অব রিজেন্টস এক্সেলেন্স অব রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড পান তিনি।
পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনের পর অধ্যাপক ড. মাকসুদুল আলম না ফেরার দেশে চলে গেলেও থেমে নেই পাট নিয়ে গবেষণা। তাঁর দেখানো পথে জিন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে তোষা ও দেশি পাটের চারটি জাত উদ্ভাবন করেছেন তাঁর অনুসারীরা। চলতি বছরই সেগুলো কৃষকপর্যায়ে অবমুক্ত করা হবে। এসব জাতের পাটের ফলন প্রচলিত জাতের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি। লবণসহিষ্ণু পাট গত বছরই জন্মেছে এ দেশে। আর মাকসুদুল আলমের জিনোম সিকোয়েন্সের স্বীকৃতি, অর্থাৎ মেধাস্বত্ব পাওয়ার খবরও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সম্প্রতি বলেছেন, মাকসুদুল আলমের মৃত্যুতে আমাদের বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। ক্ষতি হলেও আমরা তাঁর দেখানো পথ হারাইনি। তাঁর আবিষ্কার থেমে নেই। তিনি যে স্বপ্ন নিয়ে কাজ করেছেন, তা বাস্তবায়ন হচ্ছে। তোষা ও দেশি পাটের চারটি জাত শিগগিরই অবমুক্ত করা হবে। আর লবণসহিষ্ণু পাট গত বছর পরীক্ষামূলকভাবে খুলনায় চাষ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মঞ্জুরুল আলম বলেন, ‘অধ্যাপক মাকসুদুল আলম বেঁচে থাকলে আমরা আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। তাঁর মৃত্যুতে আমরা পিছিয়ে পড়লেও থেমে নেই। তিনি প্রতিটি বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর মধ্যে মাকসুদুল আলম হওয়ার স্বপ্ন গেঁথে দিয়ে গেছেন। মাকসুদুল আলমের আবিষ্কারের বিষয়গুলোর মেধাস্বত্বও আমরা পেয়েছি। আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্বের জন্য আমরা ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকচ্যুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনে (ডাব্লিউআইপিও) আবেদন করেছি। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মালয়েশিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশ আমাদের মেধাস্বত্বের স্বীকৃতি দিয়েছে। এসব স্বীকৃতি ডাব্লিউআইপিওর মাধ্যমেই এসেছে। অন্য সব দেশের স্বীকৃতি পাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক এস এম মাহবুব আলী বলেন, ড. মাকসুদুল আলম বাংলাদেশের ইতিহাসে গর্বের এক নাম। জীববিজ্ঞানের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি তাঁর গবেষণা ও উদ্ভাবন দিয়ে সারা বিশ্বের কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। তিনটি উদ্ভিদ ও ছত্রাকের জিনোম সিকোয়েন্সিং করে তিনি স্থান করে নিয়েছেন বিশ্বের সেরা কিছু বিজ্ঞানীর তালিকায়।
আরকে// এআর
আরও পড়ুন