ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০৭ নভেম্বর ২০২৪

বিশ্বব্যাংকের প্রেতাত্মা এখনো অর্থ মন্ত্রণালয়ে আছে: মির্জা আজম

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:৩৪, ৫ মার্চ ২০১৮

বিশ্বব্যাংকের কিছু প্রেতাত্মা এখনো অর্থমন্ত্রণালয়ে থাকার কারণে পাটকে কৃষি পণ্যের তালিকাভূক্ত করা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম। আজ মঙ্গলবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন।

ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এ আলোচনার আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি একুশে টেলিভিশনের পরিকল্পনা সম্পাদক সাইফ ইসলাম দিলাল।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে একটা চুক্তি করেছিল যে, বাংলাদেশের পাটকলগুলো বন্ধ করে দেবে এবং গোল্ডেন হ্যান্ডশেখের মাধ্যমে শ্রমিকদের বিদায় দেবে। একই সময় ভারতের সঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের চুক্তি হয়। সেটা ছিল ভারত নতুন পাটকল তৈরি করবে এবং আড়াই লাখ বেল পাট তারা এদেশে রফতানি করবে। ওই সময় পার্লামেন্টে পাটকল বন্ধের বিরোধিতা করে বিষয়টি তুলে ধরা হয়।

তিনি বলেন, আজও অর্থমন্ত্রণালয়সহ বাংলাদেশের চারপাশে ঘাপটি মেরে বসে আছে বিশ্বব্যাংকের কিছু প্রেতাত্মা। সে কারণে বাংলাদেশের ঐতিহ্য বহনকারী এক সময়ের একমাত্র অর্থকরী এ ফসলকে আজও কৃষি ফসলের তালিকাভুক্ত করা হয় না। এটা কৃষি ফসলের তালিকায় নিতে গেলেই চলে আসে হাজারো গবেষনা, পরীক্ষা-নীরিক্ষা ও যাচাই-বাছাইয়ের বিষয়। আমাদের অর্থমন্ত্রী পাটের প্রতি বিরূপ। ফলে তার কর্মকর্তারাও আমাদের প্রতি অনীহা দেখান। পাট মন্ত্রনালয়ের ফাইল বাংলাদেশ ব্যাংক, কৃষি মন্ত্রনালয় ও অর্থ মন্ত্রনালয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে প্রচুর সময় নষ্ট হয়।

তিনি আরও বলেন, পাট মন্ত্রনালয়ের কোনো ফাইল প্ল্যানিং কমিশনে গেলে জটিলতা সৃষ্টি হয়। আমি পাটের সঙ্গে বস্ত্র মন্ত্রণালয়েরও মন্ত্রী। বস্ত্র মন্ত্রনালয়ের কোনো ফাইল নিয়ে জটিলতা হয় না। অথচ যে পাটের সঙ্গে দেশের ৪ কোটি মানু্ষ জড়িত। সেই পাটের কোন ফাইল গেলেই তা আটকে যায়।

মির্জা আজম বলেন, একসময় বাংলাদেশ পৃথিবীতে পরিচিত ছিল পাটের জন্য। বিভিন্ন মহল থেকে বাংলাদেশের পাট শিল্পকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র হয়েছে। ৭৫- এর পর থেকে যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা পরিকল্পিতভাবে মিলগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। একইসঙ্গে কৃষককে বীজ উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করেছে। 

আদমজী আমাদের ঐতিহ্য। কিন্তু ২০০২ সালে খালেদা জিয়া এটা বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশে পাট উৎপাদন বন্ধ করে দিয়ে ভারতকে পাট রফতানিতে উৎসাহিত করার জন্য বিশ্বব্যাংক চক্রান্ত করেছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় গিয়ে পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছেন। ২০১০ সালে মান্ডেটারি প্যাকেজিং একট গৃহীত হয়। এটা কার্যকর হয় ২০১৪ সালে। আমাদের পাট শিল্পের বিরুদ্ধে দেশী ও আন্তর্জাতিক মহলে ষড়যন্ত্র চলছে।

এ ষড়যন্ত্রের মধ্যেও পাট শিল্পে গত তিন বছরে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। ২০১৫ সালে আমাদের পাটের উৎপাদন ছিল ৮৫ লাখ বেল। কিন্তু ২০১৬ সালে তা ৯১ লাখ বেলে উন্নীত হয়।  অনেক বেশি পাট উৎপাদনের পরও কৃষক ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়নি। এজন্য সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়েছে।

তিনি বলেন, বিজেএমসি এক সময় দুর্নীতিগ্রস্থ প্রতিষ্ঠান ছিল। ১৯৭১ সাল থেকে ২ বছর আগ পর্যন্ত লোকসান দিয়েছে। এখন যেটা লোকসান হচ্ছে সেটা যৌক্তিক লোকসান।পাট শিল্পে সরকার ৬০ হাজার শ্রমিককে অতিরিক্ক মজুরী দেয় ৪০০ কোটি টাকা।

তবে পাটখাতকে বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমান গুরুত্ব দিয়েছেন। এ খাতকে এগিয়ে নিতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সার্বক্ষণিক দিক নির্দেশণা দিচ্ছেন। আশা করি আগামীতে আমরা পাটে এমন একটি জায়গা করে নিব। তাতে ক্রিকেটের মতো পাট দিয়েই বাংলাদেশকে চিনবে বিশ্ব।

আগে আমাদের বহুমুখী পাট পণ্যের সংখ্যা ছিল ১৩৫টি এখন তা বেড়ে হয়েছে ২৪০টি। প্রতিদিনই নতুন নতুন পণ্য তৈরি হচ্ছে। আমাদের পাট দিয়ে জার্মান বিভিন্ন বিলাশবহুল গাড়ী তৈরির কাজে লাগাই। সেখানে এজন্য কারখানাও আছে। আমরা কাঁচা পাট রফতানি করলে তাদের কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।

আমাদের কাঁচা পাট দিয়ে ভারত, জার্মানসহ বিশ্বের অনেক দেশ পণ্য তৈরি করে লাভবান হচ্ছে। আর আমরা সে সুযোগ নিতে পারছি না। ভবিষ্যতে আমরা বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে কাঁচা পাট দিয়ে বহুমুখী পণ্য তৈরি করবো।সেক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকলেও সরকার তা নিবে। কারণ ভবিষ্যতে আমরা এক ছটাক পাঠও রফতানি করব না।

আলোচনায় বস্ত্র ও পাট মন্তণালয়ের সচিব ফয়জুর রহমান চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশে বর্তমানে পাটের বীজ তৈরি হচ্ছে না। পার্শবর্তী দেশে ভারত থেকে আমরা যে বীজ আনছি তাও নিম্নমানের। তাই পাট এগিয়ে নিতে গবেষনা ইনস্টিটিউটের সমন্বয় বাড়াতে হবে। ষাটের দশকের প্রযুক্তির বদলে আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন ঘটাতে হবে।তবেই পাটে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে।

আলোচনায় সরকারি পাটকলগুলো লোকসানের জন্য বর্তমান অপেশাদার চেয়ারম্যানকে দায়ী করে দেওয়া বক্তব্যের সূত্র ধরে বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ড. মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, আমাদের সরকারি পাটকলগুলো লোকসান করছে এ কথা আমিও বলি। আমার বিশ্বাস আমার জায়গাই এখানে অন্য কেউ আসলে ভালো করতো।কিন্তু আমি ব্যাক্তিগতভাবে বলি বিজেএমসি বন্ধ করে দেওয়া উচিত। যদিও এ কথা আমি দায়িত্বশীল হিসেবে বলছি না।

তবে বিজেএমসি কিন্তু এখনই লোকসান করছে না। এটা অনেক আগে থেকে বছর লোকসান করছে। আমাদের উচিত কেন লোকসান করছে তার কারণ উদ্ঘাটন করা। আমাকে কারণ উদ্ঘাটন করতে বলা হয়েছিল।আমি কয়েকটি কারণ পেয়েছি। যার মধ্যে সময়মত পাট কিনতে না পারা অন্যতম। এছাড়া বেসরকারি পাটকলগুলোর তুলনায় সরকারি পাটকলগুলোর বেতনবাবদ অনেক খরচ হয়। এখানে প্রায় ৯০ শতাংশ শ্রমিক স্থায়ী। যাদের মজুরী বাবদ অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়।

আলোচনায় বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনকারী এসোসিয়েশনের আহ্বায়ক রাশেদুল করিম মুন্না বলেন, বিশ্ববাজারে আমাদের পাট শিল্পের ব্যাপক বাজার আছে। এ বাজার ধরতে আমাদের সমন্বিত নীতি দরকার। পাট কৃষি পণ্য হওয়ার পর আমাদের দেশের তার কৃষি ফসলের তালিকায় স্থান পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে পাট মন্ত্রণালয় যতটা আগ্রহী, অন্যমন্ত্রণালয়গুলো ততোটা আগ্রহী নয়। পাটকে কৃষি পণ্যের তালিকায় নিয়ে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলে এ খাত নতুন উদ্যোক্তা আসবে। খাতের বৈদেশিক আয় আরো বেড়ে যাবে।

জুট ডাইভার্সিফাই প্রমোশন সেন্টারের (জেডিপিসি) নির্বাহী পরিচালক রিনা পারভিন বলেন, ২৫০ ধরণের পাটপণ্য তৈরি হচ্ছে। এসব শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বাজারে যাচ্ছে। আমরা ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি। পাট পণ্যের অতীত ফিরিয়ে আনতে দেশ-বিদেশে মেলার আয়োজন করতে হবে। আমরা ৪৯টি দূতাবাসে যোগাযোগ করেছি, পাট কর্নার করা চেষ্টা চলছে। দক্ষ জনশক্তি, ডিজাইন বহুমূখিকরণের জন্য কাজ করছি।

সাংবাদিক শাইখ সিরাজ বলেন, পাটের সময় ফিরেছে। এখন পাটের বিশ্ববাণিজ্য সম্প্রসারণ দরকার। আমাদের মিলকলগুলো পুরনো। আধুনিকায়ন, লোকবল প্রয়োজন। বিষয়গুলো মন্ত্রণালয় অবশ্যই দেখবে। পাট মন্ত্রণালয় ও পাট কমিশনের মধ্যে সমন্বয় দরকার। দুটো দুদিকে থাকলে চলবে না।

ইআরএফ  সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, দেশে পাটের পুর্নজাগরণ শুরু হয়েছে। বর্তমান সরকারের হাত ধরে পাট আবারও সোনালী অতীত ফিরে পাবে বলে আশা করি।

ইআরএফ সভাপতি সাইফ ইসলাম দিলালের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন পাট অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. সামসুল আলম, প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটের (ডিআরইউ) সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজু আহম্মেদসহ অন্যরা। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন-এএফপির ব্যুরো প্রধান শফিকুল আলম।

আরকে// এআর

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি