কেটে ফেলা চুল থেকে কোটি টাকা
প্রকাশিত : ১৯:২৯, ১৯ মার্চ ২০১৮
বাংলাদেশের মেয়েদের ঝরে পড়া চুল সংগ্রহ করার ঘটনা নতুন নয়। এটা গ্রাম থেকে শহরেও দেখা যায়। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিউটি পার্লারগুলোতে কিংবা সেলুনে প্রতিনিয়ত কাটা হচ্ছে বহু মানুষের চুল। আর এসব ফেলনা চুল দিয়েই আসছে টাকা।
শুধু দেশের বাজাই এ দিয়ে ব্যবসা হচ্ছে তা নয়, আসছে শত-কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসেবে গত অর্থবছরে বিভিন্ন দেশে এই চুল রফতানি করে আয় হয়েছে এক কোটি ৯০ লাখ ডলার বা ১৫০ কোটি টাকারও বেশি।
রাজধানীর ধানমন্ডীর একটি পুরনো পার্লার লি। সেখানে সেখানে প্রতিদিনই নারীরা সার্ভিস নিতে আসেন। তাদের বেশিরভাগই আসেন চুল কাটাতে। ক্লায়েন্টদের চুল কাটছেন কর্মীরা আর কিছুক্ষণ পরপর মেঝেতে জমা হওয়া কাটা চুল ঝাড়ু দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন পরিচ্ছন্ন কর্মীরা। এভাবে পার্লারে বা সেলুনে প্রতিদিন কাটা হচ্ছে বহু মানুষের চুল। কিন্তু এসব চুল যায় কোথায়?
লি বিউটি পার্লারের হিসাব বিভাগের পরিচালক বাদল শিমশাং জানান, আমাদের এখানে বড় চুল কেউ কাটলে পার্লারের মেয়েরা সেগুলো সংরক্ষণ করেন এবং বিক্রি করেন। তবে চুলেরও চাহিদা ক’দিন আগে ছিল, এখন নেই। আগে গ্রামের দিকে বাড়িতে বাড়িতে চুল সংগ্রহ করত ফেরিওয়ালারা। এখন শহরের অলিতে-গলিতেও চুল খুঁজতে আসেন তারা।
কলাবাগান এলাকার একজন নারী বলেন, মেয়েদের ঝড়ে পড়া চুল নিয়ে যায় ফেরিওয়ালারা, তার বিনিময়ে মেলে অন্যকিছু। ফেরিওয়ালা আইসা চুল চায়। বিনিময়ে তারা ক্লিপ, সেফটিপিন, স্টিলের বাটি, চামচ এগুলা দেয়।
কি ধরনের চুল নিতে চাযন জানতে চাইলে একজন ফেরিওয়ালা জানান, মহিলাদের মাথার চুল। বাদ নেই ছেলেদের সেলুনও। যদিও সেখানে খুব একটা বড় চুল পাওয়া যায়না তারপরও সেখান থেকেও চুল সংগ্রহ করার জন্য ঘোরাফেরা করে ফেরিওয়ালারা। বাংলাদেশে মূলত এ ধরনের চুলের বেশিরভাগ সংগ্রহ করা হয় পার্লার থেকে এবং বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে।
ঢাকার খিলগাঁওয়ের রেলগেট সংলগ্ন একটি বাড়িতে হেয়ারি নামে উইগ তৈরির কারখানা রয়েছে। এর উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিউর রহমান ২২ বছর আগে শুরু করেছিলেন কাজটি। তখন দোকানে দোকানে গিয়ে তিনি ফ্যাশন ডলের মাথায় উইগ বসানোর জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতেন। আর এখন তার কাছে প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসছেন উইগের খোঁজে।
মতিউর রহমান বলেন, এখন বিভিন্ন বয়সের মানুষেরা আসছেন নিজেদের মাথার উইগ বা পরচুলা তৈরির জন্য। কেউ চাকরির ইন্টারভিউ দেবেন বা বিয়ের পাত্রী দেখতে যাবেন, আবার কেউ টেলিভিশনে খবর পরবেন এমন অনেকে নিচ্ছেন উইগ। এছাড়া দেশের বাইরে থেকে তাদের কাছে অর্ডার আসছে।
কাটা চুল কেজি প্রতি তিন-চার কিংবা ৫০০০ টাকাতেও বেচা-কেনা চলছে। তবে চুলের আকার হতে হবে আট ইঞ্চি লম্বা। বর্তমানে কোনো কোনো কোম্পানি এই চুল আইল্যাশ বা চোখের পাপড়ি তৈরিতে ব্যবহার করছে।
বিভিন্ন বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা চুল প্রক্রিয়াজাত করা ছাড়াও চলে যাচ্ছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। শত-কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আসছে ফেলনা এসব চুল রফতানি করে। ব্যবসায়ীরা জানান, দেশের বাইরে সবচেয়ে বেশি এ ধরনের চুল যাচ্ছে ভারতে।
উইগ তৈরি ও বিক্রির প্রতিষ্ঠান হেয়ারির কর্ণধার মতিউর রহমান জানান, দেশ ও দেশের বাইরে থেকে বিভিন্ন বয়সের মানুষ তাদের কাছ থেকে উইগ নিচ্ছেন।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তালিকায় উইগ এবং হিউম্যান হেয়ারকে অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে বলা হচ্ছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি জানায় গত অর্থবছরে এই পণ্য রফতানি করে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল অর্জিত হয়েছিল তার চেয়েও বেশি।
ইপিবির পরিচালক আব্দুর রউফ বলেন, রাজশাহী নওগাঁ, চুয়াডাঙ্গাসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক জায়গাতে ফেলে দেওয়া চুল হয়ে উঠেছে অনেকের রোজগারের উৎস। মূলত স্বাধীনতার পর থেকেই এই ব্যবসাটি চলে আসছিল। তবে তা সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়তে থাকে ১৯৯৯-২০০০ সালের পর থেকে। আর রফতানি করে সবচেয়ে বেশি মুদ্রা এসেছে ২০১৫ -১৬ অর্থবছরে এক কোটি ১৪ লাখ মার্কিন ডলার। বর্তমানে চীনসহ কিছু দেশ বাংলাদেশে এসে এই খাতে বিনিয়োগও করছে। এর ফলে ছোট একটি খাত হলেও সেটি ধীরে ধীরে তা সম্ভাবনা জাগাচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে। সূত্র: বিবিসি
আর
আরও পড়ুন