‘রঙিন মাছের কারিগর’ সাইফুল্লাহ এখন কোটিপতি
প্রকাশিত : ১১:০১, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১
বাংলাদেশে অ্যাকুরিয়ামে রঙিন মাছ ব্যাপক জনপ্রিয়। শৌখিন মানুষ বাসা-বাড়িতে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য অ্যাকুরিয়াম রাখেন। শপিংমল, হোটেল, রেস্টুরেন্ট এমনকি দোকানেও এখন অ্যাকুরিয়ামের ব্যবহার বেড়েছে। এই রঙিন মাছ চাষ করে জীবন-জীবিকা পাল্টে দিয়েছেন সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার ব্রজবাকসা গ্রামের সাইফুল্লাহ গাজি। অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি দেশব্যাপী পরিচিতিও পেয়েছেন তিনি। এখন তাকে সবাই এক নামে চেনে ‘রঙিন মাছের কারিগর’ হিসেবে।
তার হ্যাচারির পানিতে ভাসছে নানা রঙের মাছ। লাল, নীল, কমলা, কালো, বাদামি, হলুদ রঙের মাছের ছড়াছড়ি। গোল্ড ফিশ, কমেট, কই কার্ভ, ওরেন্টা গোল্ড, সিল্কি কই, মলি, গাপটি, অ্যাঞ্জেল প্রভৃতি বর্ণিল মাছ দেখলে চোখ জুড়িয়ে, মন ভরে যায়।
কলারোয়ার এই তরুণ উদ্যোক্তা সাইফুল্লাহ গাজী রঙিন মাছের চাষ তার জীবনকে রাঙিয়ে দিয়েছেন। মাত্র ৬২০ টাকায় অ্যাকুরিয়াম মাছের চাষ শুরু করেন তিনি। আর সেই মাছ চাষ তাকে আজ বানিয়েছে কোটিপতি।
এক সময় বিদেশ থেকে আমদানি করা অ্যাকুরিয়ার মাছ সৌখিন ব্যক্তিদের বাসা-বাড়িতে শোভা পেত। কিন্তু উদ্যোমী সাইফুল্লাহর চেষ্টায় দেশে উৎপাদিত মাছ এখন বাসা-বাড়িতে যাচ্ছে। বর্তমানে দেড় কোটি টাকার
মূলধন খাটিয়ে ব্যবসা করছেন সাইফুল্লাহ গাজি।
বর্তমানে ২০টি পুকুরে বিভিন্ন প্রকারের অ্যাকুরিয়ামের মাছ চাষ করছেন তিনি। বিশাল মূলধন খাটানোর পাশপাশি ৫০ জন বেকারের কর্মসংস্থান করেছেন এই সাইফুল্লাহ গাজী। তার পুকুরে বাহারি রঙের মাছে সমারোহ দেখা যায়। প্রতিদিন সকালে পাত্রে শব্দ করে মাছকে খাওয়ার দাওয়াত দেন সাইফুল্লাহ। শব্দ শুনে পুকুরের এক কিনারে জমা হয় সব রঙিন মাছ। এরপর খাবার ছিটিয়ে দিলেই নিমিষেই খাবার খেয়ে তৃপ্ত হয় মাছগুলো।
সাইফুল্লাহ ও তার স্ত্রী জেসমিন সুলতানার ডাকে মাছেদের সাড়া দেয়ার এক অপূর্ব দৃশ্য দেখে অবাক স্থানীয়রা ও মাছ ব্যবসায়ীরা।
সফল উদ্যোক্তা সাইফুল্লাহ গাজী বলেন, ৭ ভাইবোনের মধ্যে আমি বড়। সংসারে অভাব থাকার কারণে বেশি লেখাপড়া করতে পারেনি। একপর্যায়ে ১৯৯৭ সালে অভাবের তাড়নায় জেদের বশবর্তী হয়ে প্রতিবেশি দেশ ভারতে কাজের উদ্দেশে। সেখানে টেক্সটাইল মিলে কাজ করার পাশাপাশি একটি গ্রামীণ এলাকায় যাই। সেখানে বেশ কয়েকটি পুকুরে নানা রঙের মাছ চাষ দেখতে পাই।
প্রায় তিন বছর ভারতে কাটিয়ে ১৯৯৯ সালে দেশে ফিরে এসে রঙিন মাছের চাষ নিয়ে বাড়িতে আলাপ- আলোচনা শুরু করি। কিন্তু প্রথমে আমার পিতাসহ বাড়ির কেউ সম্মতি দেননি। এরপর অভাবের সাথে লড়াই করে না পেরে ওই বছরেই আবারও বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টেসে কাজ শুরু করি। কিন্তু পর্যাপ্ত আয় না থাকায় সন্তুষ্টি মেলেনি। তখন ঢাকার মিরপুর-১৩ নম্বরের একটি দোকানে অ্যাকুরিয়াম দেখতে পাই।
ভারত থেকে সৃষ্ট আকাঙ্ক্ষা আর মিরপুরের দোকান দেখে অ্যাকুরিয়াম মাছ চাষের প্রতি প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তবে আগ্রহ থাকলেও মূলধন ছিল না। বেতনের সব টাকা খরচ করে অবশিষ্ট ৬২০ টাকা ছিল। সেই টাকায় পরেশ নামের এক বন্ধুর নিকট থেকে ২০০৪ সালে কয়েকটি মাছ নিয়ে বাড়িতে রওনা হই। বাড়িতে অ্যাকুরিয়ামের মাছগুলোকে এনে মাটিতে রিং স্লাফ বসিয়ে পালন শুরু করি। এক সময় মাছগুলো ডিম দেয়।
কিন্তু পুরুষ মাছের অভাবে ডিমগুলো থেকে বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছিল না। তারপর পুরুষ যোগাড় করে বাচ্চা উৎপাদন শুরু করি। এভাবেই অ্যাকুরিয়াম মাছ চাষের শুরু।
সাইফুল্লাহ গাজি আরও বলেন, প্রথমে ১০ রকমের মাছ আনলেও ৯ ধরনের মাছকেই বাঁচানো যেত না। তবে ৫ বছরের অক্লান্ত সাধনায় সব ধরনের মাছ প্রস্তুত করতে সক্ষম হই। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ৬২০ টাকার মূলধন এখন দেড় কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ২০টি পুকুর এবং ৮৮টি হাউজে ২৬ প্রজাতির মাছ রয়েছে।
এই তরুণ উদ্যোগতা বলেন, অ্যাকুরিয়ামের পেছনে এখন ৫০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। আমার চাষ করা অ্যাকুরিয়াম মাছ ঢাকার কাঁটাবন, খুলনা ও রাজশাহীসহ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশ রফতানি করার ইচ্ছা রয়েছে তার। এতে নিজে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি দেশও লাভবান হবে বলে জানান তিনি।
তবে রঙিন মাছ চাষ এখন কেবল সাতক্ষীরা অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নয়। ফেনী, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুরেও বাণিজ্যিকভাবে রঙিন মাছের চাষ হচ্ছে। এছাড়া অনেকে বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে বাসার ছাদেও রঙিন মাছের চাষ করে তা বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করছেন।
বিশেষ পদ্ধতিতে মাছের রঙ পরিবর্তন করার কথা উল্লেখ করে সাইফুল্লাহ বলেন, রঙ বদলিয়ে সিল্কি নামের একটি মাছ তৈরি করছি। অনেকটা জরির মতোই দেখতে। সে জন্যই এর নাম দিয়েছি ‘সিল্কি’। রঙ পরিবর্তন করা এ মাছের চাহিদাও রয়েছে। তবে প্রযুক্তির অভাবে পরিপূর্ণ চাষ করতে পারছি না। সরকারের প্রযুক্তি সহায়তা পেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানী করতে পারতাম। কারণ বিদেশে এ রঙিন মাছের চাহিদা ব্যাপক।
সাইফুল্লাহ বলেন, প্রতিটি মাছ সর্বনিম্ন ১০ টাকা আর সর্বোচ্চ ১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এই ব্যবসাকে ঘিরেই বড় ছেলের নামে ‘রেজা অ্যাকুরিয়াম ফিস’ নামের একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান শুরু করেছি।
সাইফুল্লাহ’র স্ত্রী জেসমিন সুলতানা বলেন, ২০০৪ সালে মাত্র ছয় জোড়া পোনা মাছ দিয়ে আমরা চাষ শুরু করি। সেই থেকে স্বামীর সঙ্গে মাছ চাষে সহযোগিতা করে আসছি। ব্যবসা বাড়াতে তখন হাতে টাকা ছিল না। পরে ঢাকা আহছানিয়া মিশন থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে মাছ চাষ সম্প্রসারণ করি। এখন আমার স্বামী একজন সফল উদ্যোক্তা।
এএইচ/
আরও পড়ুন