চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশীদের না দিয়ে দেশীয় বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান
প্রকাশিত : ২০:১৩, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২
চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির ‘লাইফ লাইন’। এই বন্দরের আয় দেশের উন্নয়নেও অবদান রাখছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বেড়েছে। এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রেখেছে দেশীয় বিনিয়োগ। এ পর্যায়ে এসে বন্দরকে বিদেশিদের হাতে ছেড়ে না দিয়ে দেশীয় বিনিয়োগ দিয়ে উন্নয়ন কাজ এগিয়ে নিতে হবে।
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে দৈনিক ইত্তেফাক আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব অভিমত ব্যক্ত করেন। ‘দেশীয় বিনিয়োগে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি।
সিনিয়র সাংবাদিক গ্লোবাল টেলিভিশনের সিইও ও এডিটর ইন চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার সঞ্চালনায় আলোচনায় প্রধান আলোচক ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শাহজাহান। আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধে বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহ-সভাপতি খায়ুরুল আলম সুজন।
গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্য রাখেন, এফবিসিসিআই’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, শিপ হ্যান্ডলিং এন্ড বার্থ অপারেটর এসোসিয়েশনের ফজলে ইকরাম চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়াডার্স এসাসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট কবীর আহমেদ, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো: আইনুল ইসলাম, কমলাপুর আইসিডি’র ডেপুটি ট্রাফিক ম্যানেজার আহমেদুল করিম চৌধুরী, বহুমুখী পাটপন্য উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতি আহবায়ক রাশেদুল করিম মুন্না, বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নূরুল কাইয়ুম খান, শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল আলী শিমুল, এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ ই মামুন, চ্যানেল টুয়েন্টি ফোরের নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন, চট্রগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৌশলী) কমোডর মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, পোর্ট স্টান্ডিং কমিটির প্রধান ও চট্রগ্রাম চেম্বার পরিচালক অঞ্জন শেখর দাশ, সিএন্ডএফ এজেন্ট এসাসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু, চট্রগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ চৌধুরী, চট্রগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি আলহাজ্ব আলী আব্বাস, এমএসিএন’র প্রজেক্ট ম্যানেজার কমোডর (অব:) সৈয়দ আরিফুল ইসলাম, যমুনা টেলিভিশনের সিইও ফাহিম আহমেদ, বৈশাখী টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, চট্রগ্রাম বন্দরের পরিচালক (পরিবহন) এনামুল করিম, চট্টগ্রাম বন্দরের চীফ প্লানিং মাহবুব মোর্শেদ চৌধুরী, পানগাঁও আইসিডির টার্মিনাল ম্যানেজার গোলাম মোহাম্মদ সরওয়ারুল ইসলাম। আলোচনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন দৈনিক ইত্তেফাকের কূটনৈতিক সম্পাদক মাঈনুল আলম।
অনুষ্ঠানে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমরা সমুদ্রে অধিকার অর্জনের পাশাপাশি দরজা খুলে রেখেছি বিনিয়োগকারীদের জন্য। তবে বাংলাদেশের স্বার্থ ও সুবিধার বিষয়টি মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। গত কয়েক বছরে বন্দর পরিস্থিতির উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরিস্থিতি এখন আগের মতো নেই। পুরোপুরি দেশীয় বিনিয়োগে বন্দরের সক্ষমতা এসেছে। বন্দর এখন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকছে। কাস্টমসের ক্লিয়ারেন্সের পর পণ্য ছাড়ে চট্টগ্রাম বন্দর দেরি করে না।
তিনি বলেন, সরকার এখন পরিকল্পনার মধ্যে নেই বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে। আমরা বিনিয়োগকারীদের জন্য পথ উন্মেুক্ত করে দিয়েছি। ২০২৬-২৭ সালে আমরা অন্যরকম একটি মেরিটাইম সেক্টর দেখতে পাব।
চট্রগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর এখন আধুনিক বন্দরে পরিণত হয়েছে। গত ১০ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে দেশীয় বিনিয়োগে প্রচুর সুযোগ রয়েছে। অনেক বেশি অফ ডকের প্রয়োজন রয়েছে। সেখানে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে পারেন। চট্টগ্রাম বন্দর মানে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহযোগী সংস্থা। এটি একটি সমষ্টিগত সংস্থা। সমষ্টিগত উন্নয়নে দেশীয় বিনিয়োগের ওপর জোর দেওয়া যেতে পারে।
আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধে বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহ-সভাপতি খায়ুরল আলম সুজন বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বন্দর হিসেবে যাত্রার পর ১৩৪ বছর পেরিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে। সমুদ্রপথে আমদানি-রফতানির ৯৩ শতাংশ হ্যান্ডলিং হয় এই বন্দর দিয়ে। আর কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয় ৯৮ শতাংশ। গত পাঁচ বছরে বন্দরে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নে বিদেশি বিনিয়োগের দরকার আছে। কারণ প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এখনো আমাদের গড়ে ওঠেনি। তবে ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অবশ্যই বাংলাদেশের হাতে থাকা উচিত। অপারেশন সেক্টরে বাংলাদেশ সক্ষমতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের দুইটি অপারেট কোম্পানি এখন দুটি দেশের বন্দর অপারেটে যুক্ত। তার সেখানে সফলতার সঙ্গে কাজ করে চলেছে।
এফবিসিসিআই’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর লাভজনক প্রতিষ্ঠান নয়, সেবাদান কারী প্রতিষ্ঠান। সেখানে পণ্য আমদানি-রফাতানিকে খরচটা সীমিত রাখতে হবে। সেটা হলে সাধারণ জনগণ উপকৃত হবে। তাই বিদেশি বিনিয়োগের চেয়ে দেশের বিনিয়োগ বাড়াতে জোর দিতে হবে।
শিপ হ্যান্ডলিং এন্ড বার্থ অপারেটর এসোসিয়েশনের ফজলে ইকরাম চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিকেরা কন্টেইনার ও জেনারেল কার্গোর ক্ষেত্রে যে শ্রম দেয় এবং তাদের যে উৎপাদনশীলতা তা অন্য কোনো দেশে আছে কিনা জানা নেই। চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অন্যতম রাজস্ব আয়কারী প্রতিষ্ঠান। উন্নয়ন ব্যয় মেটাতে চট্টগ্রাম বন্দর করতে ব্যর্থ হলে সেক্ষেত্রে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের সুযোগ দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। বিদেশিরাই কি আমাদের সমুদ্র বন্দরগুলো বানিয়ে দেবে। নাকি আমাদের নিজস্ব দেশীয় বিনিয়োগের মাধ্যমে হবে। দেশের স্বার্থকে প্রধান্য দিয়ে এ বিষয়ে ভাবতে হবে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়াডার্স এসাসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট কবীর আহমেদ বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর আজকে যে অবস্থায় এসেছে তা দেশীয় বিনিয়োগের মাধ্যমেই। আমাদের অনেক ব্যবসায়ী বিদেশি বিনিয়োগ করছেন। তারা চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নে এবং একে ঘিরে যে শিল্প গড়ে উঠছে সেখানে বিনিয়োগ করতে পারেন। এক্ষেত্রে কি ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেটা চিহ্নিত করতে হবে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো: আইনুল ইসলাম বলেন, আমাদেরকে অবশ্যই দেশীয় বিনিয়োগের দিকে নজর দিতে হবে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে আমাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কখনো কখনো কমে যায়। এক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা রক্ষায় দেশীয় বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে উদ্যোগ নিতে হবে।
কমলাপুর আইসিডি’র ডেপুটি ট্রাফিক ম্যানেজার আহমেদুল করিম চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে যেসব অফ ডক তৈরি হয়েছে তার মধ্যে ৩৭টিকে আমদানি পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর প্রত্যাশা করে শতভাগ পণ্য অফ ডকে যাক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিষয়টি অনুমোদন দিলে চট্টগ্রাম বন্দরের জটও দূর হবে এবং বেসরকারী বিনিয়োগ অনেক বেশি আকৃষ্ট হবে।
বহুমুখী পাটপন্য উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতি আহ্বায়ক রাশেদুল করিম মুন্না বলেন, চট্রগ্রাম বন্দর নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এর সাথে সংম্লিষ্ট অন্যান্য খাতের উন্নতির কথাও বলতে হবে। তিনি বলেন, সামনে আমাদের রফতানির পরিমাণ বাড়বে। সেজন্য বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। এক্ষেত্রে অবশ্যই দেশীয় বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নূরুল কাইয়ুম খান বলেন, দেশীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে সেটা অবশ্যই দেশের স্বার্থকে প্রধান্য দিতে হবে।
শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল আলী শিমুল বলেন, বে-টার্মিনাল চালু হলে ২০৩০ সাল পর্যন্ত আমাদের কোন সমস্যা হবে না। বন্দরের কাজ করার ক্ষেত্রে ভালো পরিবেশ বিরাজ করছে।
এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ ই মামুন বলেন, সমুদ্রপথে যে পরিমাণ পন্য আমদানি রপ্তানি হয় তার ৯০ শতাংশের ওপরে হয় চট্রগ্রাম বন্দর দিয়ে। মোংলা এবং পায়রা সমুদ্রবন্দরকেও পন্য আমদানি রপ্তানি কার্যক্রমের সাথে যুক্ত করতে হবে। তাঁর মতে, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে এবং কার্যক্রম পরিচালনায় দেশীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা আছে।
চ্যানেল টুয়েন্টি ফোরের নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন, চট্টগ্রাম বন্দর অর্থনীতির চালিকা শক্তি। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিদেশী বিনিয়োগের বিষয়টি স্পষ্ট করা উচিত।
এসি
আরও পড়ুন