দুই বছরে রিজার্ভ ফিরেছে দেড় কোটি ডলার
প্রকাশিত : ১৭:০৮, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৯:৫৩, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
বিশ্বব্যাপী আলোচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার ২ বছর পূর্ণ হলো আজ। দুই বছর আগের এদিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের রাজকোষ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। যার মধ্যে এ পর্যন্ত ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার ফেরত এসেছে। বাকি ৬ কোটি ৫৮ লাখ ডলারও ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সিস্টেম থেকে গত ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এরমধ্যে শ্রীলংকায় যাওয়া ২ কোটি ডলার তাৎক্ষণিক ফেরত আসে। বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চলে যায় ফিলিপাইনে। ফিলিপাইনে যাওয়া অর্থের ১ কোটি ৪৫ লাখ ডলার ফেরত এসেছে। বাকি ৬ কোটি ৫৮ লাখ ডলার (৫১০ কোটি টাকা) উদ্ধার হয়নি দুই বছরেও।
তবে উদ্ধার না হওয়া এ অর্থ ফেরত পেতে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বলে দাবি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, উদ্ধার না হওয়া অর্থের এক দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার (১২ লাখ ডলার) ফেরত আসার বিষয়ে আদালতের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এটা ফেরত আসার চূড়ান্ত পর্যায়ে। আরও ৬ মিলিয়ন ডলারের সন্ধান পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি হওয়া রিজার্ভের অর্থ উদ্ধার প্রক্রিয়ার সর্বশেষ অবস্থা জানতে ফিলিপাইনে গেছে একটি প্রতিনিধি দল। ওই দলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিআইডি প্রতিনিধিরা রয়েছেন। এতে রিজার্ভ অর্থ উদ্ধারে চলমান মামলাগুলোর খোঁজখবর নেওয়া হবে।
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের তদন্ত কমিটি ওই বছর রিপোর্ট জমা দিয়েছে। যদিও সেই রিপোর্ট আজও আলোর মুখ দেখেনি। ওই রিপোর্টে রিজার্ভ চুরির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতিকে দায়ী করা হয়। আইটি সিস্টেম উন্নত করার জন্য একটি রেমিডিয়েশন প্ল্যান হাতে নিয়েছে সরকার। এতে পুরো আইটি ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হবে। চলতি বছরের জুনে এ প্লানমাফিক বেশকিছু কাজ শেষ হবে বলে জানান গভর্নর ফজলে কবির। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত সুইফট সার্ভার সিস্টেমটি পুনর্গঠন করা হচ্ছে। আগামী জুনে এর কাজ শেষ হবে।
তবে অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশ ব্যাংক আশার বাণী শোনালেও কোনোভাবেই তাতে আশান্বিত হতে পারছেন না সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করার জন্য ফল বাংলাদেশের বিপক্ষে যাবে। রিজার্ভের অর্থ উদ্ধার একটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, সেটি আমি আগেই বলেছি। চুরির দুই বছরে মাত্র দেড় কোটি ডলার উদ্ধার হয়েছে। বাকি অর্থ উদ্ধারে আমি তেমন আশা দেখছি না। আর তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ না করার কারণে উদ্ধার হওয়ার বিষয়টি আরও বাংলাদেশের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। ফিলিপাইন অভিযোগের সুযোগ নিয়ে বলছে যে এর জন্য বাংলাদেশের অভন্তরীন হোতারাই দায়ী। ফিলিপাইনের অভিযোগের কারণে মামলায় প্রক্রিয়াধীন অর্থ প্রাপ্তিও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ১০০ কোটি ডলার সরাতে মোট ৩৫টি অনুরোধ পায় নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ। এর প্রথম চারটি অনুরোধে তারা ফিলিপাইনের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের কয়েকটি অ্যাকাউন্টে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার স্থানান্তর করে। এরপর স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে ওই টাকার প্রায় অর্ধেক চলে যায় ক্যাসিনোর জুয়ার টেবিলে। পঞ্চম আদেশে শ্রীলংকায় প্যান এশিয়া ব্যাংকিং করপোরেশনে একটি ‘ভুয়া’ এনজিও’র অ্যাকাউন্টে ২০ মিলিয়ন ডলার পাঠানো হলেও বানান ভুলে সন্দেহ জাগায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়। ৪ ফেব্রুয়ারি ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশ ব্যাংক তা আড়াল করে। ফিলিপাইনের একটি গণমাধ্যম সর্বপ্রথম বিষয়টি প্রকাশ করে। এরপর মার্চের প্রথম সপ্তাহে দেশি গণমাধ্যমগুলো বিষয়টি প্রচার করার পর সরকারের নজরে আসে। এ ঘটনায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান। অন্য দুই ডেপুটি গভর্নরকে অব্যাহতি দেয় সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, রিজার্ভ চুরির অন্যতম মূল হোতা কিম অংয়ের প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন এমন দুজনের অ্যাকাউন্টে ১২ লাখ ডলার জব্দ রয়েছে। ফিলিপাইনের সোলায়ের ক্যাসিনোর অ্যাকাউন্টে জব্দ থাকা ২ কোটি ৯০ লাখ ডলারের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি নিজ থেকে ২২ লাখ ডলার ফেরত দিতে রাজি হয়েছে। বিষয়টি দেশটির আদালতে বিচারাধীন। মামলাগুলোর শুনানি শেষ হয়েছে। এ ছাড়া চুরির অর্থ ভাঙিয়ে দেওয়ার অপরাধে লাইসেন্স বাতিল হওয়া মুদ্রা বিনিময়কারী প্রতিষ্ঠান ফিলরেমের অ্যাকাউন্টে জব্দ করা হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এই অর্থ বাংলাদেশের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার জন্য ফিলিপাইনের আইন মন্ত্রণালয় একটি ফৌজদারি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ঘটনার জেরে তৎকালীন গভর্নরের পদত্যাগ : রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে পদত্যাগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। এরপর একেএকে অব্যাহতি দেওয়া হয় দুই ডেপুটি গভর্নর নাজনীন সুলতানা ও আবুল কাশেমকে। চুরির ঘটনার ধাক্কায় ওএসডি হয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম।
ফিলিপাইনে পদত্যাগ : বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) লরেঞ্জো তান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাংকের নিয়মনীতি না মানার তথ্য-প্রমাণ উঠে আসে। এর আগে রিজাল ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখার ম্যানেজার মায়া দেগুইতি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িতদের ব্যাংক হিসাব খোলা ও রিজার্ভের অর্থ স্থানান্তরের সঙ্গে লরেঞ্জো তানের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তোলেন। ব্যবসায়ী কিম উং-ও একই ধরনের অভিযোগ তোলেন তানের বিরুদ্ধে। তবে তান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে দেগুইতির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করেন। পরবর্তীতে দেগুতো পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
মামলা : রিজার্ভ চুরি ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়। পাশাপাশি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের গচ্ছিত ওই অর্থ কীভাবে লোপাট হল, তা খুঁজে বের করতে একটি তদন্ত কমিটি করে সরকার। সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে ওই তদন্ত কমিটি করা হয়। যদিও আজও পর্যন্ত সে তদন্ত কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি। কয়েকবার প্রকাশের দিন ধার্য করেও শেষ পর্যন্ততা প্রকাশ হয়নি। অবশ্য এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, আগে থেকে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করলে ফিলিপাইনের যে দেড় কোটি ডলার ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তা নাও পেতে পারি। তাই ফিলিপাইনের অর্থ ফেরত পাওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
/ এআর /
আরও পড়ুন