দেশের পোশাক খাতে শ্রমিক অসন্তোষ কি কমেছে?
প্রকাশিত : ০৯:৩৩, ২৪ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ০৯:৩৪, ২৪ এপ্রিল ২০১৮
রানা প্লাজা ধসের আগের দিনই ভবনটিতে ফাটলের বিষয়টি নজরে এসেছিল সবার। কিন্তু তারপরও ঘটনার দিন সকালে ভবনের মালিক সোহেল রানা এবং পোশাক কারখানাগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ মিলে শ্রমিকদের কাজে যেতে বাধ্য করে।
পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে শ্রমিকদের কাজে যেতে বাধ্য করানো যেত না বলে মনে করেন শ্রমিক নেতারা।
রানা প্লাজা ধসের ছয় মাসের মধ্যেই বাংলাদেশের শ্রম আইন সংশোধন করে শ্রমিকদের শর্তসাপেক্ষে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার সহজ করা হয়।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী, রানা প্লাজা ধসের আগে কারখানা-ভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ১৩৪টি থাকলেও তাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ছিল নিষ্ক্রিয়।
শ্রম আইন সংশোধনের পর এখন কারখানা-ভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা প্রায় ৬০০টি। শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বা বিলস-এর প্রধান নির্বাহী সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমদকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, রানা প্লাজা ধসের পর গত পাঁচ বছরে শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে কতটা পরিবর্তন এসেছে?
সুলতার বলেন, মনোযোগ কিছুটা বেড়েছে। শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে যে অবজ্ঞার সংস্কৃতি ছিল সেটা কিছুটা কেটেছে।
ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা বাড়লেও শ্রমিকদের দর কষাকষির সামর্থ্য খুব একটা বাড়েনি বলে সুলতার মনে করেন।
বিলসের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, গত এক বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন গার্মেন্ট কারখানায় যেসব অসন্তোষ হয়েছে তার মধ্যে ৫৫ শতাংশই হয়েছে বেতন দেরিতে দেওয়ার জন্য।
শ্রম আইন যখন সংশোধন করা হয় তখন অনেকে সেটিকে `দায়সারা` হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। কারণ আইন এমনভাবে সংশোধন করা হয়েছে যে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠন বাস্তবে বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে হলে একটি কারখানার ত্রিশ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতি লাগবে।
এ আইন সংশোধনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মিকাইল শিপার। তিনি বলছেন, বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এটি করা হয়েছে এবং শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে এটি বড় অগ্রগতি।
‘হঠাৎ করে আমি যদি বলি চারজন শ্রমিক একজোট হলেই ট্রেড ইউনিয়ন হবে, তখন ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নিয়ে সবাই ব্যস্ত থাকবে। উৎপাদন ব্যাহত হবে। এসব কারণেই আমরা লিমিটেশন (সীমাবদ্ধতা) রেখেছিলাম,’ বলেছেন শিপার।
মালিক পক্ষ বলছে, রানা প্লাজা ধসের পর শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে মালিকরা যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েছে। সেজন্য গত পাঁচ বছরে বড় ধরনের কোন শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেনি বলে মালিক পক্ষ মনে করে। তৈরি পোশাক-খাতের অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় মালিক আরশাদ জামাল বলছেন, মালিকদের মনোভাবেও এখন পরিবর্তন এসেছে।
জামাল বলেন, যখন কোনও ঘর বা জায়গা গোছানো হয়, তখন তার সঙ্গে আচরণও গোছানো হয়। গত পাঁচ বছরে ন্যূনতম মজুরি একবার রিভাইজ (পর্যালোচনা) হয়েছে এবং প্রতি বছর পাঁচ শতাংশ হারে বাড়ানো হয়েছে। এবার মজুরি বোর্ডের জন্য আমরাই আহবান করেছি। এ থেকে আপনি বুঝতে পারছেন যে তাদের অধিকারের প্রশ্নে আমাদের মাইন্ড-সেটে (মনোভাবে) পরিবর্তন হয়েছে।
কিন্তু শ্রমিকরা কী বলছেন? তাদের অধিকার এবং কথা বলার জায়গা এখন কতটা তৈরি হয়েছে? একটি কারখানার কয়েকজন শ্রমিক বলছিলেন, এখন যে কোনও কথা সহজে মালিক পক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।
একজন নারী শ্রমিক বলছেন, আমাদের এখানে অভিযোগ বাক্স আছে। আমাদের ফ্যাক্টরিতে প্রত্যেকটা লাইন থেকে অপারেটর ডাক দিয়া নিওয়া যায়। তারা অসুবিধা-সুবিধার কথা জিজ্ঞেস করে।
তবে শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ হচ্ছে, অনেক শ্রমিক বুঝতেই পারে না তাদের অধিকার কতটা। তাছাড়া ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের জন্য ত্রিশ শতাংশ শ্রমিক যাতে একত্রিত হতে না পারে সেজন্য মালিকরা নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া ট্রেড ইউনিয়ন করতে গেলে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অভিযোগ কিংবা ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগও রয়েছে।
শিল্প মালিক আরশাদ জামাল বলছেন, যে ধরনের অভিযোগ তোলা হচ্ছে বিষয়টি সে রকম নয়। এজন্য শ্রমিক নেতাদেরও দায় আছে। সদস্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ফলে আইন অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের জন্য যতজন শ্রমিক প্রয়োজন সেটি তারা জোগাড় করতে পারছেন না বলে এ মালিক জানান।
শ্রমিক অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের অনেকেই বলছেন, গত পাঁচ বছরে বড় ধরনের শ্রমিক অসন্তোষ ঘটেনি। কিন্তু তাই বলে অসন্তোষ নেই সে কথা বলা যাবে না। বিভিন্ন সময় অসন্তোষকে চাপা দেওয়ার জন্য সরকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে প্রবল চাপ তৈরি করেছে শ্রমিক নেতাদের উপর।
এমনটাই অভিযোগ তাদের। কিন্তু সরকার দাবি করছে অসন্তোষ নয়, বরং তাদের গৃহীত নানা সংস্কারের কারণেই শ্রমিকরা এখন সে পথে পা বাড়াচ্ছে না।
সূত্র: বিবিসি
একে//
আরও পড়ুন