অটোমেটেড বিমুখতায় বন্ধ পুঁজিবাজার: ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা
প্রকাশিত : ১৮:৩২, ১৬ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ০০:২৭, ১৭ এপ্রিল ২০২০
করোনাভাইরাসের সতর্কতার মধ্যেও সচল রয়েছে বিশ্বের সব দেশের পুঁজিবাজার। ব্যতিক্রম বাংলাদেশে। গত ২৬ মার্চ থেকে বড় ধরনের দরপতন ও ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে দেশের ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে তারল্যের এই বাজার থেকে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। কৌশলগত বিনিয়োগকারীরাও বিদ্যমান পরিস্থিতির সুযোগে কম দরে শেয়ার কেনা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
অটোমেটেড ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রায় সব দেশেই চালু রয়েছে লেনদেন। অথচ অটোমেটেড পদ্ধতিতে লেনদেন চালুর পর ২২ বছর পেরিয়ে গেলেও ব্যক্তিনির্ভরতা কাটাতে না পারায় বর্তমান পরিস্থিতিতে বন্ধ রাখতে হচ্ছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার। এতে বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন না করলেও জরুরি সেবা ছাড়া পুরো দেশের সব অফিস-আদালত, কল-কারখানাসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রাখা হয়েছে। জনসাধারণকে ঘর থেকে বের না হওয়ার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। সরকারি ছুটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্টক এক্সচেঞ্জও গত ২৬ মার্চ থেকে লেনদেনসহ সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। যদিও এ সময় সীমিত পরিসরে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও লেনদেন সম্পন্ন করার জন্য ক্লিয়ারিং হাউজ চালু রেখেছে। তবে বিনিয়োগকারীদের নগদ অর্থের প্রয়োজন হলেও পুঁজিবাজার বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
এশিয়া, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজার এরই মধ্যে নভেল করোনাভাইরাসের ধাক্কা কিছুটা সামলে নিয়েছে। জাপানে জরুরি অবস্থা জারির পরও পুঁজিবাজার চালু রাখা হয়েছে। নভেল করোনাভাইরাসের ভয়াবহ আক্রমণে পর্যুদস্ত ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রেও চালু রয়েছে পুঁজিবাজার। ফিলিপাইন দুদিনের জন্য পুঁজিবাজার বন্ধ রাখলেও পরবর্তী সময়ে আবারো চালু করেছে। এমনকি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কৌশলগত বিনিয়োগকারী চীনের শেনঝেন-সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেনও চালু রয়েছে। এছাড়া বেশকিছু দেশে সময়সীমা কমিয়ে এনে হলেও বাজারের লেনদেন চালু রাখা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে সরকারি ছুটি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় পুঁজিবাজারের কার্যক্রম।
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ১৯৯৮ সালে অটোমেটেড পদ্ধতিতে লেনদেন চালু হয়। কিন্তু অটোমেটেড লেনদেন চালুর পর ২২ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো পুঁজিবাজার সচল রাখতে ব্যক্তির উপস্থিতি বাধ্যতামূলক এখানে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন্স সিস্টেমের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর অ্যাকাউন্টিং ফর ক্যাপিটাল মার্কেট ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মিজানুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজার কখনো বন্ধ হয় না। এর কারণ হচ্ছে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকে অন্যতম লিকুইড অ্যাসেট হিসেবে গণ্য করা হয়। বর্তমানে পুঁজিবাজার বন্ধ থাকায় বিনিয়োগকারীরা তাদের সম্পদ বিক্রি করতে পারছেন না। এটি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পুঁজিবাজারে একটি কার্যকর ও পূর্ণাঙ্গ অটোমেটেড সিস্টেম গড়ে তুলতে না পারার পেছনে স্টক এক্সচেঞ্জ ও বিএসইসির পাশাপাশি সরকারেরও দায় রয়েছে। পুঁজিবাজার পরিচালনার সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট রয়েছেন, তারা দক্ষতার সঙ্গে একটি কার্যকর বাজার গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন। পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে দ্রুত লেনদেন চালু করা উচিত। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা ব্রোকারেজ হাউজে না এসে টেফিফোন, অনলাইন ও মোবাইল অ্যাপস, যার যেটা সুবিধা সেভাবে লেনদেন করবেন।
পুঁজিবাজার চালু রাখার সঙ্গে স্টক এক্সচেঞ্জসহ ব্যাংক, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কার্যক্রম চালু রাখার সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকে সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সীমিত আকারে লেনদেন চলছে। অন্যদিকে সরকারের সাধারণ ছুটি ঘোষণার কারণে বিএসইসি, সিডিবিএল, স্টক এক্সচেঞ্জ ও ব্রোকারেজ হাউজগুলোর কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এ কারণে বাজারের কার্যক্রমও বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
পুঁজিবাজার বন্ধ থাকার বিষয়টি দুঃখজনক উল্লেখ করে ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, উন্নত বিশ্বের পুঁজিবাজার পুরোপুরি অটোমেটেড ও অনলাইন প্লাটফর্মভিত্তিক। সেখানে মোবাইল অ্যাপগুলো অনেক কার্যকরী। যেমন শেনঝেন স্টক এক্সচেঞ্জের পুরো লেনদেন মোবাইলে হয়। সেখানে একটি ইন্টিগ্রেট সিস্টেম রয়েছে। এ সিস্টেমে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, সেন্ট্রাল ডিপোজিটুর ও সেন্ট্রাল কাউন্টার পার্টি সবাই সম্পৃক্ত। কিন্তু আমাদের এখানে পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশে বিএসইসি যদি বন্ধ থাকে, স্টক এক্সচেঞ্জও বন্ধ রাখতে হয়। পাশাপাশি সিডিবিএলও বন্ধ। ফলে ডিএসইকে চালু রাখা কিছুটা কষ্টকর বিষয়।
সরকার যদি ছুটি আরো বাড়ায়, সেক্ষেত্রে কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের পর্ষদের সিদ্ধান্ত সরকারি ছুটি যদি বাড়ে, দুঃখজনক হলেও এটাই বাস্তবতা যে আমাদের লেনদেন বন্ধ থাকবে। তবে যদি বিএসইসি খোলা রাখে, সেক্ষেত্রে ভিন্ন সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
অবশ্য পুঁজিবাজার বন্ধের সিদ্ধান্ত স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি, বরং সরকারি ছুটি ঘোষণার কারণেই স্টক এক্সচেঞ্জ বন্ধ রাখতে হয়েছে বলে জানান ডিএসইর চেয়ারম্যান মো. ইউনূসুর রহমান। তিনি বলেন, পুঁজিবাজার বন্ধের সিদ্ধান্ত কিন্তু স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি। সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার কারণে স্টক এক্সচেঞ্জের কার্যক্রমও স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ রাখতে হয়েছে। তবে এটি ঠিক যে দীর্ঘদিন স্টক এক্সচেঞ্জ বন্ধ থাকলে বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগকারীরা আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ সপ্তাহের মধ্যে আমরা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে পর্ষদ সভা করব। সেখানে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে। সাধারণ ছুটি যদি ২৫ এপ্রিলের পর আরো বাড়ানো হয়, সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিচেনায় সীমিত পরিসরে হলেও পুঁজিবাজার চালু রাখা যায় কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে।
ডিএসইসির পাশাপাশি লেনদেন বন্ধ রয়েছে দেশের আরেক পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই)। তবে লেনদেন চালু রাখা যায় কিনা সে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন সিএসইর চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহীম। তিনি বলেন, পুরোপুরি অটোমেটেড না হওয়ার কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের এখানে পুঁজিবাজারে লেনদেন চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অবশ্য লেনদেন দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলে বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে। তাই লেনদেন চালু করা সম্ভব কিনা এ বিষয়ে আমাদের পর্ষদ সভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন বোধে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ডিএসইর সঙ্গে আলোচনা করে সমন্বিতভাবে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
লেনদেনের জন্য ডিএসইর মোবাইল অ্যাপস থাকলেও অধিকাংশ বিনিয়োগকারীই এটি ব্যবহার করছেন না। তাছাড়া টেলিফোন ও অনলাইন অর্ডারের মাধ্যমে লেনদেন করার সুযোগ থাকলেও তা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পায়নি। অধিকাংশ বিনিয়োগকারী এখনো ব্রোকারেজ হাউজে গিয়েই লেনদেনে অভ্যস্ত। অন্যদিকে সিএসইতে ক্লাউড ও চিত্রা নামে দুটি অ্যাপস আছে।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ৯ মার্চ থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ডিএসই মোবাইল অ্যাপসে মোট ৫২ হাজার ৮০৬ বিনিয়োগকারী নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে ডিএসই ইনভেস্টর অ্যাপসে নিবন্ধন করেছেন ১৭ হাজার ২২৮ জন। ডিএসই মোবাইল ট্রেডারে নিবন্ধনকারীর সংখ্যা ৩৪ হাজার ৪৮। আর ডিএসই মোবাইল ভিআইপিতে নিবন্ধন করেছেন ১ হাজার ৫৩০ জন। ডিএসই মোবাইল অ্যাপসটি চালু হওয়ার পর থেকে চলতি বছরের ৫ মার্চ পর্যন্ত মোট ১ কোটি ৮৪ লাখ ৪৯ হাজার ৩৬৩টি অর্ডার বা লেনদেনের আদেশ করা হয়েছে। এর মধ্যে কার্যকর হয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯৩টি অর্ডার।
দেশে পুঁজিবাজার চালু রাখতে হলে বিএসইসির সার্ভিল্যান্স বিভাগ খোলা রাখতে হয়। কিন্তু সরকারের সাধারণ ছুটি ঘোষণার কারণে বিএসইসি বন্ধ রয়েছে। ফলে স্টক এক্সচেঞ্জ পুঁজিবাজারে লেনদেন চালু রাখতে চাইলেও বিএসইসি বন্ধ থাকলে সেটি সম্ভব নয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেন, যদি স্টক এক্সচেঞ্জ পুঁজিবাজার চালু রাখতে চায়, তাহলে বিএসইসির পক্ষে সার্ভিল্যান্স বিভাগ চালু রাখার বিষয়টি কঠিন কিছু নয়। অতীতে বন্ধের দিনেও বিএসইসির সার্ভিল্যান্স বিভাগ চালু রাখার নজির রয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে লেনদেন চালুর বিষয়ে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কোনো প্রস্তাব আসেনি। যদি এ ধরনের কোনো প্রস্তাব আসে, তাহলে কমিশন সেটি বিবেচনা করে দেখবে। অবশ্য সবার আগে জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। পুঁজিবাজার চালু হলে স্টক এক্সচেঞ্জ ও ব্রোকারেজ হাউজগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, সেটিও বিবেচনা করতে হবে।
এদিকে নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সরকারি ছুটি আরো দীর্ঘায়িত হলে এবং পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ থাকলে ব্রোকারেজ হাউজ ও বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট ও ইবিএল সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ছায়েদুর রহমান। তিনি বলেন, পুঁজিবাজার চালু রাখতে হলে ব্রোকারেজ হাউজগুলোয় অন্তত ৫০ শতাংশ কর্মীর উপস্থিতি থাকতেই হবে। আবার বর্তমানে ব্যাংকিং লেনদেনের সময়সীমা সীমিত করে আড়াই ঘণ্টা করা হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে পুঁজিবাজারে ৪ ঘণ্টা লেনদেন হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে সীমিত আকারে লেনদেন চালু করলে সেটি ২ ঘণ্টার কম হলে চলবে না। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে লেনদেন বন্ধ থাকায় ব্রোকারেজ হাউজগুলোর আয়ও বন্ধ। লেনদেন যদি আরো দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ থাকে, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান আরো বাড়বে। তাছাড়া লেনদেন বন্ধ থাকায় অনেক বিনিয়োগকারী জরুরি প্রয়োজন হলেও শেয়ার বিক্রি করে নগদ অর্থ নিতে পারছেন না। তাই সবকিছু বিবেচনা করে যদি লেনদেন চালু করা সম্ভব হয়, তাহলে সেটি ইতিবাচক হবে।
আরকে//
আরও পড়ুন