দুই দশক পেরিয়ে একুশে বশেমুরবিপ্রবি
প্রকাশিত : ১৬:২৫, ৮ জুলাই ২০২১ | আপডেট: ১৬:৩৬, ৮ জুলাই ২০২১
২০০১ সালের ৮ জুলাই জাতীয় সংসদে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ আইন পাসের মাধ্যমে জাতির পিতার জন্মভূমি গোপালগঞ্জে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে বশেমুরবিপ্রবি। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সালে।
বৃহত্তর ১২ জেলায় ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার। প্রথম পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য ৬টি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করা হয়। এই ৬টির মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ একটি।
১৯৯৯ সালের ১৫ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. এম খায়রুল আলম খানকে প্রকল্প পরিচালক নিযুক্ত করে গোপালগঞ্জে পাঠানো হয়। প্রকল্প পরিচালক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্বাচন, জমি অধিগ্রহণ এবং জমি ভরাটের কাজ সম্পন্ন করেন।
২০০১ সালের ৮ জুলাই মহান জাতীয় সংসদে আইন পাসের পর একই বছরের ১৩ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ১৯ জুলাই মহামান্য রাষ্ট্রপতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম. খায়রুল আলমকে বশেমুরবিপ্রবির উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন।
এরপর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ২০০২ সালের ১৫ এপ্রিল চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পটি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পুনরায় বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ২০০৯ সালের নভেম্বরে আওয়ামী লীগ সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজটি পুনরুজ্জীবিত করে।
২০১০ সালের ৫ জানুয়ারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও প্রকল্প পরিচালক হিসেবে প্রফেসর ড. এম. খায়রুল আলম খানকে নিয়োগ করেন এবং ২০ জানুয়ারি ২০১০ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ আইন-২০০১ বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় এসআরও জারি করে। পরবর্তীতে ১৪ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান প্রফেসর ড. এম. খায়রুল আলম খানকে পুনরায় ৪ বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন।
২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাসে চারটি অনুষদ; প্রকৌশল, বিজ্ঞান, ব্যবসা অধ্যয়ন এবং মানবিক অনুষদে পাঁচটি বিভাগ যথাক্রমে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও ইলেক্ট্রনিক্স, গণিত, ব্যবস্থাপনা ও ইংরেজি বিভাগ খোলা হয়। প্রতি বিভাগে ৩২ জন করে মোট ১৬০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি যাত্রা শুরু করে।
বর্তমানে ৭টি অনুষদের অধীনে ৩৪টি বিভাগ ও ৩টি ইনস্টিটিউটে প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের তথ্য মতে, শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য নিয়োজিত রয়েছে ২৭২ জন শিক্ষক। এর পাশাপাশি ১১২ জন কর্মকর্তা ও ২৫১ জন কর্মচারীর সমন্বয়ে চলছে বশেমুরবিপ্রবি।
৫৫ একর জমিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে একটি ৫ তলা বিশিষ্ট আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু একাডেমিক ভবন, যা সম্প্রতি ৬ তলায় রুপান্তরের কাজ চলছে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য রয়েছে ৫ তলা বিশিষ্ট ৪টি আবাসিক হল। যথাক্রমে- বিজয় দিবস হল, স্বাধীনতা দিবস হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, শেখ রেহানা হল। ছাত্রদের জন্য ৬ তলা বিশিষ্ট শেখ রাসেল হল।
এছাড়া প্রশাসনিক ভবন, একুশে ফেব্রুয়ারি লাইব্রেরি ভবন, ক্যাফেটারিয়া, কেন্দ্রীয় মসজিদ, মন্দির, উপাচার্যের বাসভবন, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য ২টি ডরমিটরি, ২টি কোয়ার্টার, ১টি পিএইচডি ডরমিটরি, কর্মচারীদের জন্য ৩টি স্টাফ কোয়ার্টার, পানি শোধনাগার। নির্মাণাধীন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- মেইন গেট, ১০তলা বিশিষ্ট একটি নতুন একাডেমিক ভবন। এছাড়া শীঘ্রই ১৫ কোটি ব্যয়ে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণের কথা রয়েছে।
আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, চলছে ছাত্রীদের জন্য স্বতন্ত্র খেলার মাঠ নির্মাণের কাজ, কংক্রিটের রাস্তা নির্মাণের কাজ প্রায় শেষের দিকে। এখানে রয়েছে আধুনিক ল্যাবরেটরি এবং দ্রুত গতির ইন্টারনেট (ব্রডব্যান্ড ও ওয়াই ফাই) সংযোগের ব্যবস্থা। আরও রয়েছে দৃষ্টিনন্দন লেক, টিলা, ৫০ প্রজাতির আমগাছসহ বিপুল উদ্ভিদরাজি। যা দর্শনার্থীদের জন্য চিত্তের খোরাক তৈরি করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন প্রশাসক তাপস বালার তথ্য মতে, শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ১৭টি বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি বাস ও একটি কোস্টার রয়েছে। উপাচার্যের ও প্রকল্প পরিচালকের জন্য রয়েছে একটি করে গাড়ি। এছাড়া ৩টি মাইক্রোবাস, ১টি পিকআপ ও চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত ১টি এম্বুলেন্স রয়েছে।
ক্যাম্পাসের উল্লেখযোগ্য স্থান- জয়বাংলা চত্ত্বর, আই+ওয়ান চত্ত্বর, ফুচকা চত্ত্বর, শেখ হাসিনা চত্ত্বর, শহীদ মিনার, আইআর চত্ত্বর, আইন চত্ত্বর, অর্ঘ্য চত্ত্বর, লিপুস ক্যান্টিন, বালুর মাঠ, সোবহান সড়ক, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, লেকপাড়, টিলা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোও ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। বশেমুরবিপ্রবি সাংবাদিক সমিতি, ডিবেটিং সোসাইটি, বিএসএমআরএসটিইউ মডেল ইউনাইটেড নেশনস এসোসিয়েশন, সায়েন্স ক্লাব, বিএনসিসি, রোভার, শিল্প ও সাহিত্য সংঘের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ব্যান্ড দল সাদাকালো, কূপজল, অচিনপাখি-সহ বেশ কিছু সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ বছর মেয়াদে এ পর্যন্ত ৩ জন উপাচার্য নিয়োগ পেয়েছেন। ২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ড. এম. খায়রুল আলমের দায়িত্বকাল শেষ হয়। এরপর রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. খোন্দকার মোঃ নাসিরউদ্দিনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। তার ৪ বছরের দায়িত্বকাল শেষে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাকে নানা কারণে অপসারিত করা হয়। এরপর ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর উপাচার্য হিসেবে পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. একিএম মাহবুব।
গোপালগঞ্জ শহর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের অদূরেই ছায়া নিবিড় পরিবেশে অবস্থান করছে বশেমুরবিপ্রবি। প্রতি বছর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ও গবেষণায় ভূমিকা রেখে চলেছেন। দেশে-বিদেশে আলো ছড়াচ্ছেন অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী।
স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গর্বিত জন্মস্থানে তারই নামে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে মানুষের প্রত্যাশার পারদটা একটি উঁচুই। ২০০২ সালে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টির কাজ ৮ বছর বন্ধ না থাকলে এ বিশ্ববিদ্যালয়টির ২১ বছরে পদার্পণের মাহেন্দ্রক্ষণটি হতে পারতো আরও বেশি সমৃদ্ধ।
২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ৫১ কোটি ৬০ লাখ টাকার বাজেট পাস করা হয়েছে৷ অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের ৩য় পেজে ৭৫০ কোটি টাকার কাজ হওয়ার কথা রয়েছে৷ উন্নয়ন প্রকল্পের নিরবচ্ছিন্নতা অব্যাহত থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়টি ভবিষ্যতে শিক্ষা ও গবেষণায় আরও ব্যাপক পরিসরে ভূমিকা রাখতে পারবে এমনটিই প্রত্যাশা সকলের।
উপাচার্য ড. একিউএম মাহবুব বলেন, ‘আমার লক্ষ্য থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্পূর্ণরূপে দুর্নীতিমুক্ত করা এবং শিক্ষার মান উন্নয়ন করা। এছাড়া অবকাঠামো এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। এই জায়গাগুলোতে উন্নয়ন করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে অধিক গবেষণা হয় সেজন্য গবেষণা খাতকে গুরুত্ব দেয়া হবে। গবেষণা খাতে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হবে।’
এএইচ/
আরও পড়ুন