‘কোটা পদ্ধতির পুনর্মূল্যায়ন দরকার’
প্রকাশিত : ১৮:৩০, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ২০:০৪, ১ মার্চ ২০১৮
একসময় নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া যেতো। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটে। এখন তো সেটি আরও ব্যাপকতা পেয়েছে। এইচএসসি-এসএসসির পর প্রাথমিক সমাপনীর প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো ঘটনাও ঘটছে। প্রযুক্তির কল্যাণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগের রাতেই প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে। সেই প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন দেশের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে হুমকির মুখে এমনকি বিপর্যায়ে ফেলে দিচ্ছে এ প্রশ্নফাঁস।
গত একমাস জুড়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বড় জায়গাজুড়ে স্থান পেয়েছে এসএসসিতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর। এ নিয়ে তুমুল বির্তক চলছে দেশজুড়ে। একের পর এক প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে দেশের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। এ থেকে উত্তরণে ওপেন বুক এক্সামের প্রস্তাব করেছেন শিক্ষাসচিব। কেউ কেউ বলছেন, সব পরীক্ষায় সৃজনশীল পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানো দরকার। এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে অনেকেই বলছেন শিক্ষকদের তৈরি না করে শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল পদ্ধতি সংযোজন করায় বিপাকে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। যার কারণে বাধ্য হয়ে কোচিংয়ের ধারস্থ হতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। তাই সৃজনশীল পদ্ধতিকে আদর্শ শিক্ষাপদ্ধতি মানতে নারাজ বহু শিক্ষাবিদ।
এছাড়া শিক্ষাব্যবস্থা কর্মমুখী না হওয়ার কারণে একাডেমিক শিক্ষার সর্বোচ্চ সনদ নিয়েও বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছে শিক্ষার্থী, চাকরি মিলছে না। স্নাতকোত্তর পাশের পর ৩ থেকে ৪ বছর আবার চাকরির জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। করতে হচ্ছে কোচিংও। আবার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোটার মারপঁ্যাচে ধুঁকছে মেধাবীরা। তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গলদটা আসলে কোথায়? এর সুলোক সন্ধানে একুশে টেলিভিশন অনলাইন মুখোমুখি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের। তার কথায় উঠে এসেছে প্রশ্নফাঁস, কোচিং বাণিজ্য, কোটা পদ্ধতির সংস্কার, শিক্ষার্থীদের চাকরির সমস্যাসহ শিক্ষাব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি-গলদ।
আরেফিন সিদ্দিক মনে করেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি প্রথম অবস্থায় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। হলে আজকে বিষয়টি মহামারি আকারে আসতো না। এখন পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের যে দাবি উঠেছে সেটি হতে হবে শিক্ষাবিদদের পরামর্শের ভিত্তিতে, আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে নয়। শিক্ষাকে নিরেট সেবায় পরিণত করতে হলে আইন করে হলেও কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। সেইসঙ্গে চলমান কোটা ব্যবস্থার পূণ:মূল্যায়ন এখন সময়ের দাবি বলেও মনে করেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম । দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব পাঠকের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো-
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটাব্যবস্থা সংস্কারে ভূক্তভোগীরা দাবি জানিয়ে আসছেন, বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
আরেফিন সিদ্দিক: কোটা পদ্ধতি একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। সেই কারণেই আমরা এখানে কোটা পদ্ধতি করেছি। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নারীদের জন্য কোটা করলেন। অন্যান্য ক্ষেত্রেও কোটা করলেন। পরবর্তীতে সেই কোটার পরিমাণ হয়তো বাড়ানো কমানো হয়েছে, সমাজের বাস্তবতায়। কিন্তু এখন যে পর্যায়ে এসেছে, আমাদের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের সুযোগ দেওয়ার জন্য এ পদ্ধতি নিয়ে পুন:মূল্যায়ন করা দরকার। সব ক্ষেত্রেই এখন হয়তোবা কোটার দরকার নেই। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দরকার আছে। তথ্যের ভিত্তিতে এটা পুনর্গঠন করা যেতে পারে। কিন্তু একেবারে বিলুপ্তি এ মুহুর্তে সম্ভব না। এটা ধীরে ধীরে করা যেতে পারে।
প্রতিযোগিতায় যারা একটু পিছিয়ে থাকে তাদেরকে টেনে তুলতে এ কোটা করা হয়। কিন্তু এখন সময় এসেছে কোন গোষ্ঠি বেশি এগিয়ে এসেছে, কোন গোষ্ঠি এখনও পিছিয়ে আছে সেটি মূল্যায়নের। এসব বিবেচনায় নিয়ে কোটা পদ্ধতির বিন্যাসের। কারণ মেধাবীদের ক্ষতি করে কোটা প্রথা দেশের জন্য আরও বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মেধাবীরা যেন কোনোভাবে উপলব্ধি না করে যে কোটার কারণে তারা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কী কারণে বারবার প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটছে, এটা থেকে উত্তরণের উপায় কি হতে পারে?
আরেফিন সিদ্দিক: পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া ও ফাঁস প্রতিরোধের জন্য যে ধরণের কৌশলের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো সবই হয়তো কোনো না কোনো দিক থেকে প্রাসঙ্গিক। কিন্তু একইসঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার এখতিয়ার শিক্ষাবিদদের। যারা শিক্ষা নিয়ে চিন্তা করেন, শিক্ষাকার্যক্রমের সঙ্গে দৈনন্দিন জড়িত আছে। নীতি নির্ধারণটা কোথা থেকে আসবে সেটা আগে ঠিক করতে হবে।
শিক্ষাপদ্ধতি ও নীতি যদি আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের আলোকে করা হয়, তবে সেটা ঠিক হবে বলে আমরা মনে করছি না। আমাদের আগে সমস্যাটা কোথায় সেটা বের করতে হবে। তারপর সেটা দূর করণে জোর দিতে হবে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে অভিযোগ আছে, সেটা যদি প্রথম অবস্থায় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হতো, তবে আমার ধারণা আজকের এ সমস্যা মহামারি আকারে আসতো না। কিন্তু আমরা দেখেছি যাদের দায়িত্ব পরীক্ষা গ্রহণ করা ও পরীক্ষা পরিচালনা করা তারা প্রাথমিক পর্যায়ে তদন্ত তো দূরের কথা, প্রশ্নপত্র যে ফাঁস হচ্ছে এ অভিযোগটিই স্বীকার করতে চাননি। ফলে এখন প্রতিনিয়ত প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে এবং সেটা মহামারি আকারে ধারণ করেছে।
এক্ষেত্রে আমার একটাই কথা, যে কোনো উপায়ে অপরাধীদেরকে চিহ্নিত করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। তাদের খুঁজে বের করতে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ যত রকম সহযোগিতাকারী বাহিনী আছে সবাইকে কাজে লাগাতে হবে। কারণ এদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা না যায়, তবে যতরকম পদ্ধতিই আমরা গ্রহণ করি না কেন, তাতে খুব বেশি লাভ হবে না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল পদ্ধতি কিভাবে দেখছেন?
আরেফিন সিদ্দিক: শিক্ষার পাঠ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সব পদ্ধতিই সৃজনশীল। আমি মনে করি শুধু পরীক্ষা পদ্ধতিকে সৃজনশীল বলে পুরো সৃজনশীলতাকে সংকীর্ণ করে ফেলা হয়েছে। সৃজনশীলতা নিয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমি মনে করি শিক্ষার নামে যে কোচিং বাণিজ্য শুরু হয়েছে, তা যে কোনো মূল্যে বন্ধ করা উচিত। এটা আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের ধ্বংস করে দিচ্ছে। এটা বন্ধের ব্যাপারে সরকারের বিশেষ আইন করা দরকার। তবে সৃজনশীলতার প্রয়োজনে স্কুলের অপেক্ষাকৃত দূর্বল ছাত্রদের আলাদাভাবে একটু বেশি পাঠ দানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমাদের দেশে কোচিংয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। বাণিজ্য থেকে বেরিয়ে শিক্ষাকে কীভাবে নিরেট সেবায় রূপান্তর করা যায়?
আরেফিন সিদ্দিক: শিক্ষাকে নিরেট সেবায় নিতে হলে আইন করে হলেও কোচিং বন্ধ করতে হবে। এর জন্য কোনো ধরণের ছাড় বা সহনশীলতা দেখানো চলবে না। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোতেও যাতে পাঠক্রম ছাত্রদের মনে আরো বেশি নিবিষ্ট করা যায় সেজন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের পৃথকভাবে অধিক পাঠের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সেটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই।
সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হবে আগামীকাল।
/ এআর /
আরও পড়ুন