প্রাথমিকে এমসিকিউ বাদের সিদ্ধান্ত: উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা
প্রকাশিত : ১৪:৪৬, ১ মার্চ ২০১৮
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার (পিইসি) প্রশ্নপত্র থেকে এমসিকিউ বা বহু নির্বাচনী অংশ বাদ দেওয়াসহ বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নৈর্ব্যক্তিক বাদসহ শতভাগ কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতিতে (সৃজনশীল) প্রশ্ন প্রণয়ন, নতুন সফটওয়ারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে প্রশ্ন বিতরণ, আগের চেয়ে প্রশ্নসেট বেশি ছাপানো হবে। হঠাৎ করে কোনো গবেষেণা কিংবা শিক্ষাবিদদের পরামর্শ ছাড়াই প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী, অভিভাবক,শিক্ষক ও শিক্ষাবিদরা।
আগামী নভেম্বরের মাঝামাঝিতে চলতি বছরের প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। সেই হিসেবে পিইসি শুরুর মাত্র ৯ মাস আগে পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের কথা বলছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতো অল্প সময়ের মধ্যে এতো বড় একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তা বাস্তবায়ন হওয়া বা না হওয়া উভয়টি ভাবিয়ে তুলেছে অভিভাবকদের। যদি বাস্তবায়ন হয়, তবে শিক্ষার্থীরা নতুন কী পদ্ধতি পরীক্ষা দিবে, সেটার প্রস্তুতিও বা অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে নিবে। আবার যদি বাস্তবায়ন না হয়, তবে এই যে খবর এলো এতে শিক্ষার্থীদের পড়ার গতিও কমে যাবে। যা শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের অসম্পূর্ণ প্রস্তুতিতে পরীক্ষা দিতে বাধ্য করবে।
সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি এসএসসি পরীক্ষার প্রায় প্রতিটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে। এ অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকায় প্রায় শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে সারাদেশে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক। এ কারণে সমাপনী-ইবতেদায়ি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে আরও সর্তকতা অবলম্বন করছে মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মাসিক সমন্বয় সভায় পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নপত্র থেকে এমসিকিউ (নৈর্ব্যক্তিক) বাদ দিয়ে রচনামূলক কী কী প্রশ্ন যুক্ত করা যায় সে বিষয়েও কাজ শুরু হয়েছে।
এছাড়া শিক্ষানীতি অনুযায়ী শতভাগ সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা আয়োজন, প্রশ্ন বিতরণের সময় প্রশ্নপত্র যেন ফাঁস না হয় সে কারণে সফটওয়ারের মাধ্যমে ৮ দিনের মধ্যে প্রশ্ন বিতরণ (আগে ২৫ দিন সময় প্রয়োজন ছিল) করা হবে, ৬ সেট প্রশ্নপত্রের বদলে ৮ সেট তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারের সভাপতিত্বে আয়োজিত ওই সভায় মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরসহ প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, ২৫ ফেব্রুয়ারি সভায় মন্ত্রী মোস্তফিজুর রহমান ফিজার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় নৈর্ব্যত্তিক বা বহু নির্বাচনী প্রশ্ন তুলে দেওয়া সমীচীন হবে উল্লেখ করে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেন। এছাড়া প্রশ্নপত্র ছাপানোর ক্ষেত্রে বিজি প্রেসের বিকল্প আরেকটি প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের বিষয়েও তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
এদিকে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি চলতি বছরের জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) থেকে চলতি বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার এমসিকিউসহ (নৈর্ব্যতিক) প্রশ্নপত্রের কাঠামো ও নম্বর বিভাজের রূপরেখা সারাদেশের স্কুলগুলোতে পাঠানো হয়েছে। এই আদেশ জারির মাত্র ৮ দিন পর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থেকে এমসিকিউ (নৈর্ব্যতিক) পদ্ধতি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে মন্ত্রণালয়।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, নানা পর্যবেক্ষণে নৈর্ব্যত্তিক প্রশ্নফাঁস হওয়ার ঘটনা জানা গেছে। এ কারণে আগামী নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে আয়োজিত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় এমসিকিউ (নৈর্ব্যত্তিক) অংশ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নৈর্ব্যত্তিক বাদ দিয়ে কোন ধরনের রচনামূলক প্রশ্ন যুক্ত হবে তা নির্ণয় করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে অনুয়ায়ী প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর নেপকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছে বলেও জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চলতি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি বৈঠকে পাবলিক পরীক্ষা থেকে এমসিকিউ বাদ দেয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। সেই মোতাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পিইসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থেকে এমসিকিউ অংশ বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থেকে এমসিকিউ অংশ বাদ দেয়া হবে কিনা এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এছাড়া গত ১৯ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন সাংবাদিকের প্রশ্নফাঁস সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, পরীক্ষা শুরুর ২০ মিনিট আগে প্রশ্ন দেয়, এটা তো জানা কথা। এখন সবার হাতে ফোন, কেউ ছবি তুলে দিতে পারে। কিন্তু আমার এই প্রশ্নের উত্তরটা দেন, কেউ কি এটা দেখে উত্তর পড়ে লিখে দিতে পারবে? এত ট্যালেন্টেড কে আছে? তাহলে বলেন, টিক মার্কটা (এমসিকিউ) বন্ধ করে দেব? আপনারা লেখেন আমরা বন্ধ করে দেব। মূলত প্রধানমন্ত্রীর এই কথাকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্দেশনা হিসেবে নিয়ে প্রশ্নপত্র থেকে এমসিকিউ অংশ বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে এমসিকিউ অংশ তুলে দেয়ার বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. কায়কোবাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করতে না পেরে এমসিকিউ পদ্ধতি উঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক হয়নি। সারা পৃথিবী যেখানে এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেয় সেখানে আমরা এটা পারছি না। কেন পারছি না? আমরা কি খারাপ জাতি? তিনি পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, এমসিকিউ বাতিলের মতো পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কারের দিকে গেলেও এটি নিয়ে কোনো গবেষণা কি করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়? তার মতে, পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কার করতে হলে অনেক চিন্তাভাবনার প্রয়োজন। একটা বিষয়ে সমস্যা হলো, আর আমরা কোনো গবেষণা না করেই বাতিল করে দিলাম- এমন অস্থিরতা দিয়ে পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কার করা যায় না। পরীক্ষা পদ্ধতি বদলাতে প্রয়োজন স্থিতিশীলতা।
তবে এমসিকিউ বাতিলের পক্ষে মত দিয়ে আরেক শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, পৃথিবীর বহু দেশে এমসিকিউ অংশ রয়েছে এবং ভালো ফলাফলও দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এটি ভালো নয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বড় কারণ হয়ে দাঁড়ানোর পাশাপাশি এই পদ্ধতি মুখস্থবিদ্যাকেও বাড়িয়ে তুলছে। এখন এই পদ্ধতি তুলে দেয়ায় ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে বলে তিনি মনে করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) থেকে চলতি বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় শতভাগ যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্নপত্রের কাঠামো জারি করা হয়। এতে প্রাথমিকের ৬টি বিষয়ের মধ্যে বাংলায় ১০ নম্বর, ইংরেজিতে ২০ নম্বর, গণিতে ২৪ নম্বর, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়ে ৫০, প্রাথমিক বিজ্ঞানে ৫০ ও ধর্ম বিষয়ে ৫০ নম্বরের এমসিকিউ প্রশ্নপত্র রাখা হয়। কিন্তু নতুন নির্দেশনার আলোকে এমসিকিউ বাদ দিয়ে ওসব জায়গায় রচনামূলক প্রশ্ন সংযুক্ত করা হবে। কি রকমের রচনামূলক প্রশ্ন যুক্ত হবে সেটি এখনো বলছে না প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একাধিক শিক্ষক বলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ভেবেচিন্তে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় না। তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় ভুল করে। আর ভুলের খেসারত দিতে হয় আমাদের মতো শিক্ষকদের। ৯ মাস আগে পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কার হলে আমরা এই সময়ের মধ্যে বাচ্চাদের গড়ে তুলব কি করে?
রাজধানীর রামপুরা এলাকার বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম নামের একজন অভিভাবক বলেন, গত বছর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা হবে না। এই সিদ্ধান্ত জানানোর তিনদিন পরে মন্ত্রণালয় বলে দিল, সমাপনী পরীক্ষা হবে। এবার বলছে এমসিকিউ হবে না। এমসিকিউ হবে না ভালো কথা, কিন্তু এটি ৯ মাস আগে কেন বলবে? ভেবেচিন্তে আরো আগে বলা উচিত ছিল।
হঠাৎ মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তে আগামী ইবদেদায়ী ও প্রাথমিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা ভালো করতে পারবে না। তাদের শিক্ষা ও অধ্যয়নে একটি ছন্দ পতন হলো। ছন্দ পতনের কারণে তারা যেমন পরীক্ষায় নিজেদের প্রস্তুত করতে পারবে না। অভিভাবকরা তেমন উদ্বীগ্নতা কেটে উঠতে পারবে না।
আরকে// এআর
আরও পড়ুন