‘পিইসি-জেএসসি বাদ দিতে হবে’
প্রকাশিত : ১৯:৫৫, ১ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৮:৪০, ৩ মার্চ ২০১৮
অধ্যাপক এম এম আকাশ
গত একমাস জুড়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বড় জায়গাজুড়ে স্থান পেয়েছে এসএসসিতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর। এ নিয়ে তুমুল বির্তক চলছে দেশজুড়ে। একের পর এক প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে দেশের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। এ থেকে উত্তরণে ওপেন বুক এক্সামের প্রস্তাব করেছেন শিক্ষাসচিব। কেউ কেউ বলছেন, সব পরীক্ষায় সৃজনশীল পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানো দরকার। এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে অনেকেই বলছেন শিক্ষকদের তৈরি না করে শিক্ষাব্যবস্থায় সৃজনশীল পদ্ধতি সংযোজন করায় বিপাকে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। যার কারণে বাধ্য হয়ে কোচিংয়ের ধারস্থ হতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। তাই সৃজনশীল পদ্ধতিকে আদর্শ শিক্ষাপদ্ধতি মানতে নারাজ বহু শিক্ষাবিদ।
এদিকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কর্মমুখী না হওয়ার কারণে একাডেমিক শিক্ষার সর্বোচ্চ সনদ নিয়েও বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছে শিক্ষার্থী, চাকরি মিলছে না। স্নাতকোত্তর পাশের পর ৩ থেকে ৪ বছর আবার চাকরির জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। করতে হচ্ছে কোচিংও। আবার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোটার মারপ্যাচে ধুঁকছে মেধাবীরা। তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গলদটা আসলে কোথায়? এর সুলোক সন্ধানে একুশে টেলিভিশন অনলাইন মুখোমুখি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশের সঙ্গে। তার কথায় উঠে এসেছে প্রশ্নফাঁস, কোচিং বাণিজ্য, কোটা পদ্ধতির সংস্কার, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা, শিক্ষার্থীদের চাকরির সমস্যাসহ শিক্ষাব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি-গলদ। তিনি মনে করেন শিক্ষাপদ্ধতির সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। পাবলিক পরীক্ষা কমিয়ে পিইসি ও জেএসসি অথবা পিইসি-এসএসসি পরীক্ষা বাদ দেওয়ার পক্ষে মত দেন তিনি। সেই সঙ্গ চাকরিতে প্রবেশে বয়সসীমা থাকা উচিত নয় বলে মনে করেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টিভি অনলাইন প্রতিবেদক আলী আদনান।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন : প্রশ্নফাঁস এ সময়ের একটি আলোচিত বিষয়। প্রশ্নফাঁস হওয়ার পেছনে কারণ কী থাকতে বলে আপনি মনে করেন?
এম এম আকাশ: প্রশ্নফাঁস এখন একটা কেলেংকারির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ঘোষণা দিয়ে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। কেউ কেউ বলে দিচ্ছে,আমরা প্রশ্নফাঁস করব। আপনি ঠেকাতে পারলে ঠেকান। একটা চ্যালেঞ্জ দিয়েই চ্যালেঞ্জটা কার্যকরী করা হচ্ছে। আগে প্রশ্ন ফাঁস হতো দু’ভাবে। হয় বিজি প্রেস থেকে দুর্নীতি পরায়ন কর্মচারীরা লোভে পড়ে প্রশ্ন ফাঁস করত। কিংবা কোচিং শিক্ষকরা (যারা প্রশ্ন প্রণয়নে দায়িত্ব পেতেন) তারা প্রশ্ন সরবরাহ করতেন। কিন্তু এখন যারা প্রশ্নফাঁস করছে তারা জোটবদ্ধ। এটা এই চক্রের আয়ের অন্যতম উৎস। সেজন্য তারা প্রশ্ন ফাঁসে টাকা বিনিয়োগ করছেন, লোকবল রাখছেন। অর্থাৎ, প্রশ্নফাঁস যারা করছেন, তাদের দু’টি শক্তি আছে। যথা: পুঁজির শক্তি ও প্রযুক্তির শক্তি। এখন, পুঁজির শক্তি ও প্রযুক্তির অপব্যবহারের বিরুদ্ধে লড়াই করার সক্ষমতা শিক্ষা মন্ত্রনালয় বা পুলিশের আছে কি না সেটাই প্রশ্ন।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ প্রশ্নফাঁস রোধের উপায় কী?
এম এম আকাশঃ প্রশ্নফাঁসের জন্য প্রধানত দুটি কারণকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়। একটা হলো শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সক্ষমতার অভাব। অন্যটা হল শর্ষের মধ্যে ভূত। সক্ষমতার অভাব থাকতেই পারে। তবে শর্ষের মধ্যে ভূত আছে এটাই সত্যি। কেননা, যে সরকার জঙ্গি ধরতে পারে, অল্প সময়ের ব্যবধানে বড় বড় অপরাধী ধরতে পারে, সেই সরকার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের সনাক্ত করতে পারবে না, তা আমি বিশ্বাস করি না। এছাড়া ইতোমধ্যে আমরা সবাই জেনেছি, গণমাধ্যমে দেখেছি, প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরাও জড়িত। তাই `শর্ষের মধ্যে ভূত` কথাটা অমূলক নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, দু`টা জিনিসই সত্য। শর্ষের মধ্যে ভূত আছে, এটা যেমন সত্য তেমনি সক্ষমতার অভাব আছে এটাও সত্য। তাই দু`টো জিনিস রোধ করা না গেলে এ সমস্যার সমাধান হবে না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ অনেকে প্রশ্নফাঁসের জন্য সাইবার টেকনলজিকে দায়ী করছে? আপনি কী তাদের সঙ্গে একমত?
এম এম আকাশঃ না, আমি একমত নই। মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলে দেওয়া যায় না। তাছাড়া এটা সম্ভবও নয়। এটা করতে গেলে প্রত্যেককে চেক করে রুমে ঢুকাতে হবে। প্রত্যেকটি কম্পিউটার নজরদারিতে রাখতে হবে। সেটা সম্ভব নয়। আমরা কিন্তু শনাক্ত করতে পারছি না, কে প্রথম সেটা কম্পিটারের মাধ্যমে ফাঁস করছে। শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে ভূত তাড়াতে হবে। সাইবারকে দোষ দিয়ে লাভ কী? আবার সাইবার টেকনোলজিকে দায়ী করলে ফেসবুক বন্ধ করতে হবে। কিন্তু প্রযুক্তি এখন এত উন্নত, ফেসবুক বন্ধ করলেও অনেকে মেধা খাটিয়ে ফেসবুক ব্যবহারের সুযোগ পায়। এটা আমাদের সক্ষমতার অভাব। তাই টেকনোলজিকে আমি দায়ী করি না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ অনেক শিক্ষাবিদ সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি বাদ দিয়ে পুরনো পদ্ধতিতে ফিরে যেতে বলছেন? সেটা কী গ্রহণযোগ্য?
এমএম অাকাশঃ আমি ব্যক্তিগতভাবে তা সমর্থন করি না। পুরনো পদ্ধতিতে ছেলে মেয়েরা নকল করতে উৎসাহী ছিল। নকল প্রতিরোধের জন্যই সৃজনশীল পদ্ধতি প্রচলন করা হয়েছে। তবে হ্যাঁ, আমাদের শিক্ষকরা সৃজনশীল পড়াশুনায় অভ্যস্ত বা সক্ষম নন। সৃজনশীল পদ্ধতি তো খারাপ না। এটা আধুনিক পদ্ধতি। এর ফলে সুবিধা হলো ছেলে মেয়েরা মুখস্থ বিদ্যা থেকে বের হয়ে এসে মাথা খাটিয়ে উত্তর দিবে। সেই প্রশ্নের ধরন ও পাঠদান পদ্ধতি `বিশেষ` বলে আমি মনে করি। কিন্তু আমাদের শিক্ষকরা সেই পাঠ দানে ও প্রশ্নপত্র প্রণয়নে সক্ষমতা রাখেন না। যেহেতু আমাদের শিক্ষকরা পদ্ধতিটা আয়ত্ত্বে আনতে পারেননি, তাই তারা গাইড বই নির্ভর হচ্ছেন। এর ফলে, গাইড বইগুলো একই রকম প্রশ্ন ছাপাচ্ছে। সৃজনশীল প্রশ্ন কীভাবে করতে হয় আগে সেই ট্রেনিংটা দিতে হবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আপনি কি তাহলে শিক্ষাপদ্ধতি পরিবর্তনের কথা বলছেন?
এমএম আকাশঃ হ্যাঁ, যেহেতু আপাত দৃষ্টিতে ভূত তাড়ানো কঠিন, তাই বিকল্প চিন্তা করা যায়। যেমন: আমরা পাবলিক পরীক্ষা কমিয়ে দিতে পারি। আমরা পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষা (পিইসি) বাদ দিতে পারি। বা পঞ্চম ও অষ্টম (জেএসসি) দুটোই বাদ দিয়ে সরাসরি এসএসসি পরীক্ষা নিতে পারি। এরকম প্রস্তাবনা এখন বিভিন্ন দিক থেকে আসছে। আবার ভিন্ন দিক থেকেও ভেবে দেখা যায়। আমরা যদি আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের অষ্টম শ্রেণী থেকে ভিন্ন স্ট্রীমে নিয়ে যেতে চাই তাহলে অষ্টম শ্রেণীতে একটা পাবলিক পরীক্ষা দরকার। সেক্ষেত্রে অষ্টম শ্রেণী ও উচ্চ মাধ্যমিকে দুটি পাবলিক পরীক্ষা থাকতে পারে। দুটি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করা আর চারটি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রন করা এককথা নয়। দ্বিতীয়ত পাবলিক পরীক্ষা কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি আলাদা আলাদাভাবে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিতে পারে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান। এর ফলে তারা নিজেরা প্রশ্ন করবে। বোর্ডকে দায়িত্ব নিতে হবে না। ফলে প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্র যখন দেখবে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক অনেক কমে গেছে, তখন তারা প্রশ্ন ফাঁসে উৎসাহী হবে না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ একজন শিক্ষক হিসেবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মানকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এমএম আকাশ : আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক সমস্যা। সবচেয়ে বড় সমস্যা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষকদের মানোন্নয়ন হয়নি। আগে শিক্ষকদের মান বাড়াতে হবে। এর জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া যায়। শিক্ষকের বেতন বাড়ানো দরকার। মানসম্মত জীবন যাপনের জন্য যথেষ্ট বেতন পেলে শিক্ষকরা ক্লাস ও ছাত্রছাত্রীদের প্রতি মনোযোগী হবেন। একজন শিক্ষককে সারা জীবন পড়তে হয়। পড়ে নিজেকে আপ-টু-ডেট রাখতে হয়। প্রত্যেক শিক্ষকের যদি অন্তত একটা কম্পিউটার থাকে এবং সে যদি এটা ব্যবহারে দক্ষ হয়, তাহলে আপ-টু-ডেট থাকা সম্ভব। শ্রেষ্ঠ শিক্ষকরা যদি অন্য শিক্ষকদের জন্য রেগুলার ক্লাস নেন তাহলেও আপ-টু-ডেট থাকা সম্ভব। শিক্ষকরা এখন যেসব নিয়মিত ট্রেনিংগুলো পায় তা আরো আধুনিক, যুগোপযোগী ও কার্যকরী করা দরকার।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরন চলছে। বেরিয়ে আসার উপায় কী?
এমএম আকাশঃ পুঁজিবাদ নির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় সবকিছুই বাণিজ্যিকীকরণ হবে। রাষ্ট্র সব শিক্ষার্থীর শিক্ষার দায়িত্ব নেবে, এটা কিন্তু আমাদের সংবিধান স্বীকৃত কথা। আওয়ামী লীগের আগের ইশতেহারেও বলা হয়েছে, স্নাতক পর্যন্ত রাষ্ট্র শিক্ষার দায়িত্ব নেবে। আমার বিশ্বাস, কঠিন হলেও আমরা শিক্ষার বাণিজ্যিকিকরণ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতিতে মানবিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, নীতি নৈতিকতার অভাব আছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। এর কারণ কী?
এমএম আকাশঃ `নগর পুড়িলে দেবালয় কী এড়ায়` প্রবাদটা কিন্তু সত্য। দেশের কোথায় মানবিক মূল্যবোধ, নীতি নৈতিকতা ও দেশপ্রেম আছে? সেখানে আমরা শিক্ষায় এই তিনটি বিষয় আশা করি কীভাবে? সমাজ ও রাষ্ট্রে দেশপ্রেম, মানবিক মূল্যবোধ, নীতি নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত হলে, শিক্ষা ক্ষেত্রেও তার প্রভাব পড়বে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার জন্য আন্দোলন চলছে। এ দাবি কতটুকু সমর্থনযোগ্য?
এমএম আকাশ : বয়স নির্ধারণ করা হয় কর্মক্ষেত্রে শারিরীক দক্ষতাকে কাজে লাগানোর জন্য। কিন্তু আমরা তো চাকরী-ই দিতে পারছি না। যেহেতু দিতে পারছি না, সেখানে বয়সের বাধ্যবাধকতা অযৌক্তিক। যারা আন্দোলন করছেন, তাদের দাবি যুক্তিসঙ্গত। চাকরি পাবে কী পাবে না সেটা নিয়োগ পরীক্ষায় নির্ধারিত হবে। কিন্তু সে আবেদন করার অধিকার রাখে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আমরা জনসংখ্যার বোনাস যুগ অতিক্রম করছি। এ সুযোগটা আমরা কীভাবে কাজে লাগাতে পারি?
এমএম আকাশঃ অনেক বছর পরপর এই সুযোগটা আসে। প্রায় দেশই এই সুযোগটা একটা সময় পায়, যখন তার মোট জনসংখ্যায় তারুণ্যের আধিক্য বেড়ে যায়। তখন তার শ্রম ব্যবহারের সক্ষমতা বেড়ে যায়। আমরা এখন সে সময়টা পার করছি। এখন আমরা যতো সহজে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক বিকাশ ঘটাতে পারব, পরে আর তা পারব না। যেমন- জাপানে এখন বৃদ্ধ লোকের সংখ্যা বেশি। এই অবস্থায় একটা জাতি নিজের অর্থনৈতিক বা সামাজিক বিকাশে কষ্ট হয়। তাই আমাদের এই সুযোগটা কাজে লাগানো উচিত।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আপনাকে ধন্যবাদ।
এমএম আকাশঃ আপনাকেও ধন্যবাদ। আবার দেখা হবে।
/ এআর /
আরও পড়ুন