কোটা সংস্কারে কী ভাবছেন তরুণরা
প্রকাশিত : ২১:২৪, ১৭ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৩:০১, ২৭ মার্চ ২০১৮
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা সংস্কারের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ও চাকুরি প্রার্থীরা। কোটা সুবিধার ফলে একদিকে যেমন মেধাবী ও যোগ্য চাকরীপ্রার্থীরা নিয়োগে বঞ্চিত হচ্ছেন তেমনি কোটাভিত্তিক পদগুলোতে কোটাধারীদের মধ্য থেকে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে পদগুলো বছরের পর বছর থেকে যাচ্ছে শূন্য। দীর্ঘদিন থেকে এভাবে চলে আসলেও সাম্প্রতিক সময়ে এর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে দেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি বিশেষ করে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা প্রচলিত। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী কোটায় ১০, জেলা কোটা ১০, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য পাঁচ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে এক শতাংশ কোটা। বাদবাকি ৪৪ শতাংশ আসনের জন্য লড়াই করছেন সংখ্যাগুরু বিপুল সংখ্যক মেধাবী। সংখ্যাগুরু সাধারণ চাকরিপ্রার্থী এবং সংখ্যালঘু কোটাধারীদের মধ্যে এত বড় বৈষম্য সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। একুশে টেলিভিশন অনলাইনের পক্ষ থেকে কথা বলেছিলাম কোটাবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছেন এমন কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে। তারা মনে করেন বৈষম্য অবসানের জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হলেও কোটা প্রথা চালু থাকায় সেই বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। তারা বলছেন সরকারের সোনালি অর্জনগুলো ম্লান করে দেওয়ার জন্য এই কোটাগুলোই যথেষ্ঠ। তাদের বক্তব্যগুলো তুলে এনেছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনের প্রতিবেদক আলী আদনান।
"অনগ্রসর জাতির জন্য কোটা"
যে বৈষম্যের জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সরকারি চাকুরিতে কোটার দিকে তাকালে বুঝা যায় সেই বৈষম্য আজও বিদ্যমান। সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জাতির জন্য কোটার প্রয়োজন আছে তবে সেটা সীমিত পরিমানে এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। পৃথিবীর প্রায় দেশেই কোটা যদি থাকে তাহলে সেটা নির্দিষ্ট সময়ের পর অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। একজন স্বচ্ছল বড় সরকারি আমলার ছেলে যদি কোটা প্রয়োগ করে সরকারি চাকুরি পায় তাহলে কি আপনি সেই আমলার পরিবারকে অনগ্রসর বলবেন? ঠিক তেমনি ভাবে বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রীর ছেলে কোটা প্রয়োগ করে চাকরি পেলে তাকে আপনি অনগ্রসর বলতে পারেন না।
ইমরান মিয়া, এমবিএ
শেখ বোরহান উদ্দিন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজ
"সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন কোটা পদ্ধতি"
বর্তমান সরকারের সকল সোনালি অর্জন ম্লান করে দেওয়ার জন্য সরকারি চাকুরিতে বর্তমান সময়ে ৫৬ শতাংশ কোটা পদ্ধতিই যথেষ্ট। সংবিধানের ১৯ (১) ধারায় রাষ্ট্র প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করবে বলে যে কথা রয়েছে তার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এই ৫৬ শতাংশ কোটা পদ্ধতি। নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা থাকতে পারে, তবে হ্যা সেটা হতে হবে যৌক্তিক। অন্যান্য কোটার নামে মেধাবীদের বঞ্চিত করার অনাচার থেকে জনপ্রশাসনকে মুক্ত করা উচিৎ। সমাজের কোন অংশকে বিশেষ সুবিধা দিতে গিয়ে অন্যায্যভাবে বৃহত্তর অংশকে বঞ্চিত করাটা সমাজ এবং জাতির জন্য একটি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত বলেই আমি মনে করি।
প্রিয়াংকা হাওলাদার, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ (এমএ)
ইডেন মহিলা কলেজ।
"মেধাবীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে"
সরকারি চাকরির প্রতিটি ক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার সংস্কৃতি চালু থাকা প্রয়োজন। সাময়িক ভাবে ১০ শতাংশ কোটা চলতে পারে এর বেশি নয়। এর চেয়ে বেশি কোটার প্রয়োগের ফলে মেধাবীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে যাচ্ছে।
মাহবুবা আক্তার, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ (এমএ)
ইডেন মহিলা কলেজ
"দ্রুত কোটা পদ্ধতির সংস্কার করা হোক"
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে স্থায়ীভাবে কোন কোটাব্যবস্থা নেই। যেসব দেশে আছে সেখানে নিয়মিতভাবে তা সংস্কার করা হয়। নাগরিকদের সুযোগের সমতার কথা সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা থাকলেও চাকুরি ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে সংবিধান লঙ্ঘনের মতো কাজ হচ্ছে। আরও দেশে যেসব কোটা প্রচলিত রয়েছে সেখানে প্রতিবন্ধী ছাড়া আর কেউই এখন পিছিয়ে পড়ার মধ্যে পড়েনা। একটা মানুষ কী সারা জীবনই পিছিয়ে পড়া থাকবে! তাদের কী আজীবন সুযোগ দেওয়া হবে! এটা অনেক হাস্যকর ব্যাপার। তাই কর্তৃপক্ষের উচিৎ দ্রুত কোটা পদ্ধতির সংস্কার করা এবং আমাদের মেধার স্বাভাবিক বিকাশের পথ খোলে দেওয়া।
ঝলক দেব পরিসংখ্যান বিভাগ (এমএসসি)
সিলেট এমসি কলেজ
"কোটা সংস্কার করা এখন সময়ের দাবি"
দেশে চাকুরি ক্ষেত্রে বিরাজমান মুক্তিযোদ্ধা, আদিবাসী, জেলা, নারী সহ সব ধরনের কোটার সংস্কার হওয়া প্রয়োজন। তবে একমাত্র প্রতিবন্ধী কোটা রাখা যায়। এ ক্ষেত্রে কোটা শিথিল করার পাশাপাশি কোটা সংস্কার করা এখন সময়ের দাবি।
শাহিন সর্দার, ইংরেজি বিভাগ ( এমএ)
কবি নজরুল সরকারী কলেজ
"কোটা ব্যাবস্থার আমূল পরিবর্তনই একমাত্র কাম্য"
একবার কোটা শিথিল করা হলে এটা গলার কাঁটা হয়ে যাবে। তখন একদিকে চেতনাবাজি করা যাবে, অন্যদিকে আন্দোলন করা থেকে ছাত্রদেরকে দমনও করা যাবে। আমার প্রশ্ন হলো কোটায় সাবডিভিশন কেনো থাকবে। কেউ ২২৬তম হয়ে কোনো ক্যাডারই পাবে না আর কেউ ২০০০-৩০০০তম হয়ে জেনারেল ক্যডার হয়ে যাবে- এটা অন্যায়ের মধ্যে আরেক অন্যায়। যদি কোটা শিথিল করতে হয় তবে তা এমনভাবে করতে হবে যাতে ৫০০টা জেনারেল ক্যাডারভুক্ত পদ থাকলে কেউ ৫০১তম হয়েও জেনারেল ক্যাডার হতে পারবে না তা যতই কোটাধিকার থাক। অন্যথায় বিসিএসে কোটা শিথিল করলেও বেশিরভাগ চাকুরীপ্রার্থী এর সুফল পাবেনা। কারণ অনেকেরই টেকনিক্যাল বা প্রফেশনাল ক্যাডারে যাওয়ার জন্য বিষয় ভিত্তিক যোগ্যতা নাই। আর বর্তমান সিস্টেমে কোটা শিথিল করলে জেনারেল ক্যাডারে বিদ্যমান বৈষম্য বজায় থাকবে। সুতরাং কোটাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনই একমাত্র কাম্য হওয়া উচিৎ।
শাহাদাত কিবরিয়া
খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
"কোটা প্রথা বৈষম্যের পরিচায়ক"
সংবিধানের ২৯ নং ধারায় সরকারি নিয়োগ লাভের সুযোগের সমতার কথা স্পষ্টভাবে বলা আছে। ২৮ (৪) ধারার দোহাই দিয়ে সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির অগ্রগতির কথা বলে কার্যত পুরো দেশকে অনগ্রসর করে দেওয়া হচ্ছে। দেশ বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত মেধাবীদের সেবা থেকে। বিদ্যমান পরিস্থিতি বিরাজমান থাকলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন তা নিছক স্বপ্নই থেকে যাবে। মনে রাখতে হবে, ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ এবং বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যে বিস্তর তফাৎ রয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দরবারে রোল মডেল।
মো. মহিউদ্দিন, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা কলেজ
আরও পড়ুন