প্রযুক্তির অপব্যবহার করে প্রশ্নফাঁস করা হয়েছে
প্রকাশিত : ১৮:১২, ২১ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৬:১১, ২২ মার্চ ২০১৮
সালেহা খন্দকার
প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু এর অপপ্রয়োগ বয়ে আনে অকল্যাণ। অামরা প্রযুক্তিকে সঠিক ব্যবহার না করে প্রযুক্তির দাস হয়ে গেছি। পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোতে সবার হাতে কিন্তু মোবাইল ফোন নেই। তারা সবসময় ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে না। পুঁজিবাজারের কৌশল হিসেবে বড় বড় কোম্পানীগুলো অামাদেরকে বেছে নিয়েছে টাকা চুষে নেওয়ার জন্য। এজন্য সবার হাতে মোবাইল ফোন, সবার হাতে ইন্টারনেট ধরিয়ে দিয়েছে। এটি মোটেও ভাল কথা নয়। প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণেই প্রশ্নফাঁস হচ্ছে। প্রশ্নফাঁস বন্ধে প্রযুক্তির অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন শিক্ষাবিদ ও গবেষক টিচার্স ট্রেনিং কলেজের কম্পিউটার অপারেশন সুপারভাইজার/সহকারী অধ্যাপক সালেহা খন্দকার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক অালী অাদনান।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অামদের শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা প্রশ্নফাঁস। এই প্রশ্নফাঁসের জন্য অাপনি কাকে দায়ী করবেন?
সালেহা খন্দকার: প্রশ্নফাঁসের জন্য শুধুমাত্র একজনকে দায়ী করার সুযোগ নেই। শিক্ষার পুরো সিস্টেমটাই প্রশ্ন ফাঁসের জন্য দায়ী। একটি সহজ কথা বলি। প্রশ্ন প্রনয়ণ করা থেকে শুরু করে পরীক্ষার হলে যাওয়া পর্যন্ত অনেকগুলো প্রক্রিয়া অাছে। এসব প্রক্রিয়ায় অনেকগুলো জনবল জড়িত। যেসব জনবল জড়িত তাদের ছেলেমেয়েরা কী পরীক্ষা দিচ্ছে না? সেখান থেকেও তো প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। এখানে প্রত্যেকটা স্টেজে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা অাছে। অাবার সবসময় যে একই প্রক্রিয়ায় ফাঁস হচ্ছে তা নাও হতে পারে। এবছর হয়তো একভাবে প্রশ্ন ফাঁস হলো, গত বছর বা তার অাগের বছর হয়তো অন্যভাবে ফাঁস হয়েছিল।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: প্রশ্নফাঁসের জন্য প্রযুক্তিকে দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু উন্নত বিশ্বে প্রযুক্তি অারো অনেক বেশী উন্নত। সেখানে কিন্তু প্রশ্নফাঁস হচ্ছে না। কেন?
সালেহা খন্দকার: প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু অামাদের এখানে হয়ে গেছে উল্টো। অামরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার না করে প্রযুক্তির দাস হয়ে গেছি। বিদেশে সবার হাতে কিন্তু মোবাইল ফোন নেই। তারা সবসময় ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে না। কিন্তু পুঁজিবাজারের কৌশল হিসেবে বড় বড় কোম্পানিগুলো অামাদেরকে বেছে নিয়েছে টাকা চুষে নেওয়ার জন্য। সবার হাতে মোবাইল ফোন, সবার হাতে ইন্টারনেট মোটেও ভাল কথা নয়। একটা ছোট বাচ্চার হাতে যদি ছুরি দেওয়া হয় সে বুঝবে না ছুরি দিয়ে অাপেল কাটতে হবে নাকি হাত কাটতে হবে। ঠিক তেমনি অনেক মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যাবহারকারী জানে না প্রযুক্তিকে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। এ ব্যাপারে কঠোর নীতিমালা অানা উচিত।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অাপনি প্রযুক্তির অপব্যাবহার বলতে কী বুঝাতে চাচ্ছেন?
সালেহা খন্দকার: এদেশে কত বছর বয়স হলে বা কোন কোন ক্ষেত্রে মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে তা নিয়ে সঠিক কোন নীতিমালার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ছোট ছোট শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন দেওয়া হয় খেলার জন্য। এর ফলে খুব অল্প বয়সে শিশুদের মধ্যে পর্ণো অাসক্তি অাসার সম্ভাবনা দেখা দেয়। রাত জেগে ফেসবুক ব্যবহার করার ফলে ঘুমের ক্ষতি হয়। এর ফলে একদিকে যেমন স্বাস্থ্যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তেমনি পড়াশুনার ক্ষতি হয়। অামাদের প্রশ্নফাঁস, ইয়াবা, পর্ণো অাসক্তি এক সুতোয় বাধা। এগুলোর পেছনে অবশ্যই প্রযুক্তির অপব্যহার দায়ী। হ্যাঁ, অামি প্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ করার কথা বলছি না। অামি বলছি, স্কুলে চক-ডাস্টার অামরা যেভাবে টুলস হিসেবে ব্যবহার করি, প্রযুক্তিও সেভাবে ব্যবহার করা উচিত। প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে যাওয়া বা প্রযুক্তি অামাদেরকে নিয়ন্ত্রন করবে- তা কোনো ভাল দিক নয়। নির্দিষ্ট বয়সের অাগে শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন অাসা উচিত নয়।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অাপনি বিভিন্ন সময় কোচিং বাণিজ্যের বিরুদ্ধে বলে অাসছেন। অনেকে তো কোচিংকে দরকারিও দাবি করছে...
সালেহা খন্দকার: কোচিং বাণিজ্য যারা করছে তারা কিন্তু বাইরের কেউ নয়। এরাই কোনো না কোনো ভাবে বোর্ডে প্রশ্ন করার সঙ্গে জড়িত। মডারেশন করার সঙ্গে জড়িত। প্রশ্নফাঁসে জড়িত। এরাই কোনো না কোনোভাবে স্কুল পরিচালনা করছে। প্রশ্নফাঁসে এবার কোচিং সেন্টারগুলো সম্পৃক্ত থাকার কথা কিন্তু এবার গণমাধ্যমে এসেছে। প্রতিযোগিতার বাজারে তারা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে প্রতিবছর বেশি এ প্লাস দাবি করছে। অার এ প্লাসের জন্য বেছে নিচ্ছে প্রশ্নফাঁসের মতো নৈতিক অবক্ষয়ের পথ।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন হাতে পেতে অামাদের অভিভাবকরা মরিয়া ছিল। এটা কী একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির ইঙ্গিত নয়?
সালেহা খন্দকার: অবশ্যই। বলার অপেক্ষা রাখে না অামাদের নৈতিক অবক্ষয় খুব চরম পর্যায়ে অাছে। অাবার একটু বিপরীত দিক থেকে চিন্তা করি। সমাজ, রাষ্ট্র অামাকে শিখিয়েছে অামার সন্তানকে এ প্লাস পেতে হবে। এ প্লাস না পেলে চলবেই না। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে। না হলে জীবন বৃথা। এরকম একটা দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ওই জায়গা থেকে সব বাবা-মা এখন এ প্লাস পাওয়াটাকে সন্তানের ভবিষ্যতের অন্যতম নিশ্চয়তা মনে করে। তারা যখন দেখেন অন্য ছাত্র ছাত্রীরা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পাচ্ছে তখন তারা নিশ্চিন্তে বসে থাকবেন কীভাবে? তারাও সেই একই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: শিশুদের প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখতে বলছেন। অামরা তো তাদের বিনোদনের কোনো সুযোগ দিতে পারছি না। তাদের কোনো খেলার মাঠও নেই। তাহলে তাদের বিকেলটা কাটবে কোথায়?
সালেহা খন্দকার: হ্যাঁ, অামিও সেজন্যই বলছি পুরো সিস্টেমটাই পরিবর্তন করা দরকার। প্রযুক্তির অপব্যবহার-প্রশ্নফাঁস শুধু একটা সমস্যা নয়। বরং অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে একটা দিক মাত্র। তাদের খেলার মাঠ নেই। টিভিতে শিশুদের জন্য কোনো শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান নেই। তাদের এখন বই পড়ার অভ্যাস নেই। নোংরা অপসংস্কৃতি অামাদের অাগামী প্রজন্মকে গ্রাস করার জন্য হা করে দাঁড়িয়ে অাছে। অামরা যদি শিশুদেরকে সুন্দর পরিচর্যা দিতে ব্যর্থ হই, তাহলে অাগামীতে এ জাতি বনসাই হয়ে যাবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: শিক্ষাব্যবস্থায় বড় কোন ধরনের গলদগুলো অাপনার চোখে পড়ে?
সালেহা খন্দকার: শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকে বড় বড় গলদ অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে অাছে। তাই বাহির থেকে হঠাৎ করে চোখে পড়ে না। গলদগুলোর জন্য কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দায়ী করার সুযোগ নেই। যেমন ধরুন, গ্রামের স্কুলগুলোতে কোন ভাল শিক্ষক বদলি হয়ে যেতে চান না। সবাই চান শহরে থাকতে। তিন বছর পর পর সরকারী নিয়ম অনুযায়ী সরকারী শিক্ষক বদলি হওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু দেখা যায় কোনো কোনে প্রতিষ্ঠানে এক শিক্ষক ২৪-২৫ বছর করে থেকে যাচ্ছেন। অাবার সেখানে রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতা থাকছে। গ্রামের কলেজ- স্কুলগুলোতে নিয়োগ হয় রাজনৈতিক সুপারিশে। মেধাবী যোগ্য নিয়োগ প্রার্থীরা এক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়। অাবার ধরুন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের পদ অাছে চল্লিশটি। কিন্তু শিক্ষক অাছেন ১২০ জন। কারণ তারা গ্রামে যাবেন না। তাহলে সেখানে পড়াশুনার পরিবেশটা থাকে কীভাবে? অাবার গ্রামের দিকে বিপরীত চিত্র অাছে। সাবজেক্ট অাছে। কিন্তু শিক্ষক নেই। সব স্কুলে অাইসিটি সাবজেক্টটা বাধ্যতামূলক। কিন্তু অধিকাংশ স্কুলে অাইসিটি শিক্ষক নেই। এটা কী ফান?
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: এসব সমস্যা থেকে উত্তোরনের উপায় কী?
সালেহা খন্দকার: সুশাসন। সব জায়গায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করা না গেলে এসব সমস্যা কখনো মিটবে না। বরং বাড়তেই থাকবে। পরীক্ষা পদ্ধতি কী রকম হলো, সিলেবাস কেমন করলো, সৃজনশীল নৈর্বত্তিক থাকলো কী থাকলো না- এসবের চেয়ে এই অনিয়মগুলো দূর করা বেশী জরুরী। গ্রামে- মফস্বলে খেয়াল করলে দেখবেন, অল্পশিক্ষিত-অশিক্ষিত লোকগুলো রাজনৈতিক দাপটে স্কুল বা কলেজ পরিচালনা কমিটির নেতৃত্বে অাসে। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কী উন্নতি করবে? এসব ব্যাপারে অাইন অাসা দরকার। রাজনৈতিক সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন অাসবে না।
/ এআর /
আরও পড়ুন