ঘামে গড়া জীবন, আগুনে পুড়ে শেষ
প্রকাশিত : ২০:২১, ২৯ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ২২:০৪, ২৯ মার্চ ২০১৮
টানা ছয় দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে না ফেরার দেশে চলে গেছেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) বস্ত্র প্রকৌশল বিভাগের মেধাবী ছাত্র শাহীন মিয়া। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আইসিইউতে মারা যান তিনি।
গতরাত পৌঁনে বারোটায় তাঁর মৃত্যু হয় বলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানিয়েছেন। শাহীনের সহপাঠী তানবীর রিফাত একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে জানান, রাতে শাহীনের হৃদস্পন্দন কমে আসা শুরু করলে শাহীন কথা বলা শুরু করেন। এই সময় তাঁর মা এদিক ওদিক ছুটে চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে হাউমাউ করে বলেন, " আমার বেটা আর কথা কয় না ক্যান! আমার বেটা নিশ্বাস নেয় না ক্যান? আপনারা আমার বেটাকে দেখেন। আমার বেটা ঘুমায় গেছে। বেটারে এই ঘুম ক্যান গেলি! দেখ! দেখ! মায়ের দিকের দেখ। বেটা চোখ খোল! বেটা আমার চোখ খোল!"
শাহীন মৃত্যুর আগে তার বন্ধু আলিফকে উদ্দেশ্য করে শাহীন বলেন, "আমি চলে যাচ্ছি, তোরা আমাকে মাফ করে দিস। আমার মাকে দেখিস!"
ঠিক আর কি কথা হয়েছিল সেটা জানা সম্ভব হয়নি। সে হয়তো অনেক কথায় বলতে চেয়েছিল তার সহপাঠীদের। হয়তো তার স্বপ্নের কথা অথবা তাঁর জীবনের সব থেকে কঠিক কথাটা! তার সে না বলা কথাগুলো বেদনায় পোড়াবে তার সহপাঠীদের।
চৈত্রের জোসনা শোভিত রাতেই একটি সম্ভাবনার মৃত্যু হলো। সিরাজগঞ্জের নিভৃত পল্লীর ছোট্ট কুঠিরে বাস করা সাফিয়া বেগমের স্বপ্নের মৃত্যু হলো। মায়ের আঁচলে মমতার স্নেহছায়ায় আর ফেরা হলো না প্রকৌশলী শাহীনের।
৮৩ শতাংশ দগ্ধ শরীর নিয়ে টানা ছয়দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পাশে শুয়ে থাকা দীপ্ত আর হাফিজকে রেখে একা মৃত্যুর মিছিলে সামিল হলেন শাহীন। পথ ধরলেন ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণকারী সহপাঠী তৌহিদুল ইসলামের।
তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। শুধুই কান্নার আওয়াজ! আইসিইউর সামনে স্বজনদের গগণবিদারী আর্তনাদে শোকে স্তব্ধ পুরো বার্ন ইউনিট। স্বজন হারানো বেদনায় মূহ্যমান হয়ে পরেছে শাহীনের সহপাঠীরা।
তাঁর বিধবা মা সন্তান হারানোর বেদনা সহ্য করতে না পেরে বাকরুদ্ব হয়ে আছেন। কোন সান্তনা বাক্য আর নিয়ে তাঁর কাছে সত্য নয়। কেবল বুকফাটা আর্তনাদ করে বলছে, "বেটা মাকে ছেড়ে একা মাটির ঘরে কি করে থাকবি।"
অন্যদিকে শাহীনের মৃত্যুতে বাকি দুই সহপাঠীর স্বজনরাও ভেঙ্গে পরেছেন। তাদের তাদের মনে এখন একটাই প্রশ্ন দীপ্ত আর হাফিজ মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরবে তো?
এমন প্রশ্নের উত্তর হয়তো কারো জানা নেই। তবে বার্ন ইউনিটের সূত্র বলছে বাঁচা মরার মালিক একমাত্র আল্লাহ। যেহেতু বাকি দু`জনের শরীরের অবস্থাও সংকটাপন্ন। ক্রমশ তাদের স্বাস্থ্যহানী ঘটছে। সময়ই বলে দিবে আদৌ সুস্থ হয়ে তাদের বাড়ি ফেরা হবে কি না? কেউই জানেন না বাকি দুজনের ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে!
বার্ন ইউনিটে আইসিইউর রেড ইউনিটের এক সিট ফাঁকা হল বাকিজনের নিয়তি কেবল সময়ের বিচারে চূড়ান্ত হওয়ার অপেক্ষায় স্বজনেরা।
জানা যায়, ময়না তদন্ত শেষে শাহীন মিয়ার মরদেহবাহী্ অ্যাম্বুলেন্স বিকেল ৪ টার দিকে তার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহবাজপুরের হাটসাতবাড়িয়া গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
নিজ বাড়ির কবরস্থানে তাঁর প্রয়াত পিতার পাশে তাকে শায়িত করা হবে। এই দিকে তাঁর মৃত্যুর সংবাদে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।
অগ্নিদগ্ধ শিক্ষার্থী শাহীন বার্ন ইউনিটের রেড ইউনিটের প্রধান অধ্যাপিকা ডা. রায়হানা আওয়াল সুমির তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
কুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবদুল জলিল বলেন, "কুয়েটের ৬৩ জন শিক্ষার্থী আজ ভোরে সিরাজগঞ্জের শাহবাজপুরের উদ্দেশ্যে রওয়া হয়। শাহীনের মৃত্যু সংবাদ ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পরলে শিক্ষার্থীরা কান্নায় ভেঙে পরেন। এই মুহূর্তে আমি আর কিছুই বলতে পারছি না। সন্তান হারানোর বেদনা যে কত কঠিন তা আমি অনুধাবন করছি।"
উল্লেখ্য, শনিবার (২৪ মার্চ) রাতে ময়মনসিংহের ভালুকায় স্কয়ার ফ্যাশন কারখানার পাশে মাস্টার বাড়ি এলাকার একটি ফ্ল্যাটে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান তৌহিদুল ইসলাম। এই ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ আরও তিনজনকে ওই রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়।
শিক্ষাজীবনের শেষের দিকে এসে কুয়েটের এই চার মেধাবী ছাত্র ময়মনসিংহের ভালুকার স্কয়ার ফ্যাশন কারখানায় শিক্ষানবিশ (ইন্টার্ন) প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ওই পোশাক কারখানার পাশে একটি ভবনের তিনতলায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতেন তারা।
টিকে
এ সংক্রান্ত আরও খবর
আরও পড়ুন