ঢাকা, সোমবার   ০২ ডিসেম্বর ২০২৪

‘চাকরির বাজার বিবেচনায় শিক্ষায় পরির্বতন আনতে হবে’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:৫১, ১১ জুন ২০১৮ | আপডেট: ১৯:২৯, ১১ জুন ২০১৮

মোহাম্মাদ আলী আক্কাস

মোহাম্মাদ আলী আক্কাস

বর্তমানে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (জনসংখ্যার বোনাসকাল) কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কোনো দেশে যদি ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ কর্মক্ষম থাকে তাহলে সে দেশকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের আওতাভুক্ত করা হয়। সে হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০১৪ সালে ডেমোগ্রাফিকট ডিভিডেন্ডে প্রকাশ করছে। ইউএনডিপির তথ্য মতে বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৬ শতাংশ মানুষ কর্মক্ষম। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকালের সুবিধা ভোগ করছে (১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সের জনসংখ্যার অধিক্য)। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ সুযোগ গ্রহণ করে ইতোমধ্যে সমৃদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে জিডিপির প্রবৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিকভাবে বহু দূর এগিয়ে যাবে। আর ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডেকে যথাযথভাব কাজ লাগতে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আমূল পরিবর্তন দরকার। এমনটাই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মাদ আলী আক্কাস

সম্প্রতি একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সুযোগ ও চ্যালেঞ্জের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন একুশে টিভি অনলাইন প্রতিবেদক তবিবুর রহমান

একুশে টিভি অনলাইন : ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট (জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল) প্রবেশ করেছে দেশ। এ সুযোগটা আমরা কতটা কাজে লাগতে পারছি বলে আপনি মনে করেন ?   

অধ্যাপক এম এ আক্কাস: বাংলাদেশে ২০০৭ সালে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল শুরু হলেও পুরোপুরি প্রবেশ করছে ২০১৪ সাল থেকে। বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। দেশের ১০ কোটি ৬১ লাখ লোক রয়েছে কর্মক্ষম। এর মধ্যে আমাদের কর্মশক্তি শ্রমিক রয়েছে ৬ কোটি ২১ লাখ। উন্নত এবং উন্নয়নশীল খুব কম দেশই এই বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী পেয়েছে। এই শ্রমশক্তিকে আমরা বাজার মুখী পড়াশোনা, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলতে পারলে এরা দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত হবে। আমরা এই সুযোগটা পুরোপোরি কাজে লাগতে পারছি না। আমাদের এ জনসংখ্যাকে জনসম্পদ  সৃষ্টি করতে দরকার শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। এ সব মানুষকে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে জনসংখ্যাকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। দক্ষ মানুষ কখনও বেকার থাকে না। গ্রামের মানুষ অশিক্ষিত হলেও বেকার নেই কারণ তারা নিজেদের কাজে দক্ষ।

বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিত লোক ৬০ শতাংশ বেকার। এর মূল কারণ শিক্ষার্থীদের বাজারমূখী শিক্ষা দিতে পারছি না। চাকরির বাজারে কোন বিষয় চাহিদা আছে এচিন্তা মাথায় রেখে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা পরির্বতন করতে হবে। দেখতে হবে বাজারে কি চাকরির চাহিদা বেশি্ এবং তা পেতে কি কি প্রশিক্ষণের প্রয়োজন সেসব বিষয় মাথায় রেখেই আমাদের শিক্ষা বব্যস্থা বাজারমূখী করতে হবে।

আমাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা চাকরির সঙ্গে কোন সর্ম্পক নেই। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। বর্তমান বাজারের চাকরির কথা মাথায় রেখেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সিলেবাস নির্ধারণ করতে হবে। বাজারমূখী ‍শিক্ষাব্যবস্থা না থাকার কারণে আমাদের দেশের বেশি বেতনের চাকরিগুলোতে আমেরিকা, ভারত, ভুটানের লোকেরা করছে। আমাদের শিক্ষা কৌশলগত পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষকদের উন্নতমানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় দক্ষ শিক্ষক অভাবের ফলে শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে দক্ষ হচ্ছে না। ফলে চাকরি পেতে অনেক দুর্ভোগ পেতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

একুশে টিভি অনলাইন : এসুযোগ কাজে লাগাদে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?

অধ্যাপক এম এ আক্কাস: ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সঠিভাবে কাজে লাগতে হলে আমাদের আগে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আকার পরিবর্তন করতে হবে। তথ্য-প্রযুক্তি প্রশিক্ষণের মানুষের এই বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যাকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। চাকরির বাজারে গুরুত্ব কথা মাথায় রেখেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে ব্যবহার করতে হবে।

বর্তমানে তথ্য-প্রযুক্তিতে কর্মসংস্থানের অনেক সুযোগ রয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ হতে পারলে কর্মসংস্থানের অভাব হবে না। বর্তমানের চীনে তথ্য-প্রযুক্তিতে কাজ করে ১০ কোটি মানুষ। ভারতে এক কোটি মানুষ কাজ করছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের কয়েক লাখ মানুষ এ খাতে কাজ করে। এর সংখ্যা বাড়াতে হবে।

বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যাকে আইটিতে দক্ষ করে তুলতে পারি। দিনে দিনে আইটির প্রসার ঘটছে। ফলে আর কিছুদিন পর মানুষ বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করবে না। অনলাইনে বসে সব কিছু করবে। এ কারণে তথ্য প্রযুক্তি প্রসার বাড়তে হবে। এছাড়া আমাদের বিপুল সংখ্যাক জনশক্তিকে কৃষি, সার্ভিস সেক্টর, ই-বিসনেজে কাজে লাগতে পারি।

একুশে টিভি অনলাইন : বিশ্বে আর কোন কোন দেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে (জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল) প্রবেশ করেছে। ওইসব দেশ কিভাবে এ সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে?

অধ্যাপক এম এ আক্কাস: চীন, থাইল্যান্ড, ভারত, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলো বিভিন্ন সময়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে প্রবেশ করেছে। অনেকেই এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করেছে। এ সুযোগ আমরা কাজে লাগতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করা দরকার। বাজারমূখী শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আর শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা কেন্দ্রিক হওয়া উচিৎ। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে হবে। যুব সমাজকে সঠিকভাবে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। অন্যান্য দেশগুলো কর্মক্ষম মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আগে ‘মাস্টারপ্ল্যান করেছে। সেই অনুযায়ী কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। সে অনুযায়ী  বাংলাদেশে এ বিষয়ে তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাই নেই।

একুশে টিভি অনলাইন : ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল) সুযোগ কাজে লাগাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো যে সব কৌশল নিয়েছে আমরা সেগুলো অনুস্মরণ করতে পারি কি না?

অধ্যাপক এম এ আক্কাস: বিশ্ববাজারে চাকরির  ভিত্তিতে বাংলাদেশে বিপুল কর্মক্ষম মানুষকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাকে বাজারমুখী করতে হবে। চাকরি বাজারে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত তাদেরকে নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তারা তাদের চাকরির বাস্তব অভিজ্ঞতা কথা বলবে। সঙ্গে সঙ্গে চাকরির বাজারে টিকে থাকতে হলে কি কি করতে হবে তারা সেবিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের মাঝে শেয়ার করবে। এর মধ্যমে দুপক্ষে মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা বৃদ্ধি পাবে। ছাত্রজীবনে রাজনীতি সঙ্গে সংযুক্ত করা যাবে না।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন :  দেশে প্রচুর কর্মক্ষম মানুষ। তারা কাজ পাচ্ছে না। এদের দক্ষ করে কাজে লাগাতে হলে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?

অধ্যাপক এম এ আক্কাস: বিশ্বের অন্যান দেশের মতো আমরা বিপুলসংখ্যাক কর্মক্ষম মানুষকে কর্মংস্থান নিশ্চিত করতে পচ্ছি না। আমাদের দেশের মালিক শ্রেণির তেমন কোনো উদ্যোগও গ্রহণ করছে না। মালিক শ্রেণির শ্রমিকদের ভালো করে প্রশিক্ষণ দিতে পাচ্ছে না। সমন্বয়ের অভাবে দক্ষ বা কোন প্রকার প্রশিক্ষণ ছাড়ায় আমাদের শ্রমিকদের বিদেশে পাঠাচ্ছে। ফলে অন্যন্যা দেশের শ্রমিক থেকে আমাদের শ্রমিকরা বেতন কম পায়।

একুশে টিভি অনলাইন : অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, আগামী ২০৩৪ সালের মধ্যে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ হারাবে বাংলাদেশ। কিভাবে আমরা এর সঠিক ব্যবহার করতে পারি?

অধ্যাপক এম এ আক্কাস : প্রত্যেক দেশে বিভিন্ন সময় ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (কর্মক্ষম বা জনসংখ্যা) সুযোগ আসে। বাংলাদেশেও ২০০৭ সালে আসলেও পুরোপরি এসেছে ২০১৪ সালে। ইতোমধ্যে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। সবার সম্মিলিতি প্রচেষ্টার মাধ্যমে এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করা সম্ভব। দেশ-বিদেশের কাজের সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলতে হবে। তাদের কাজে লাগাতে না পারলে এই সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হবো।

একুশে টিভি অনলাইন : কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সুষ্ঠু মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার একটা প্রশ্ন চলে আসে। আমরা সঠিকভাবে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা করতে পারছি কি না?

অধ্যাপক এম এ আক্কাস: আমরা মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে পারছি না। আমাদের শ্রমিকদের সঠিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে পারছি না।

আমরা যদি কোন শ্রমিকের গাড়ি চালক হিসেবে বিদেশে পাঠাই। যদি পাঠানোর আগে দেশে এক বছরে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে সঠিক বেতন নিশ্চিত করতে পারতাম।

একুশে টিভি অনলাইন: বর্তমানে বিপুলসংখ্যাক জনসংখ্যা দেশের জন্য বুঝা না সম্পদ?

অধ্যাপক এম এ আক্কাস: আমি কখনোই বুঝা বলবো না। কারণ আমরা যদি তাদের সঠিকভাবে কাজে লাগতে পারি। তাহলে অবশ্যই সম্পদ হিসেবে পরিণত হবে। আমার মনে হয় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার করা সরকারের দায়িত্ব। তেমনি কর্মসংস্থান সঠিক কাজের মাধ্যমে কাজটি ধরে রাখা আমাদের কর্তব্য। এসুযোগ যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে দেশের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ না বাড়াতে পারলে কর্মসংস্থানের নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।

একুশে টিভি অনলাইন : বর্তমানে কোন কোন খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি বলে আপনি মনে করেন?

অধ্যাপক এম এ আক্কাস: বর্তমানে  প্রযুক্তি খাতে অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া পোষাক শিল্প অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে।

একুশে টিভি অনলাইন: আপনাকে ধন্যবাদ।

অধ্যাপক এমএ আক্কাস: একুশে পরিবারকেও ধন্যবাদ।

এসএইচ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি