ঢাকা, সোমবার   ০২ ডিসেম্বর ২০২৪

বেকারত্ব দূর করতে বদলাতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি: অধ্যাপক শফি আহমেদ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:৪৭, ১ অক্টোবর ২০১৮ | আপডেট: ১৮:১৫, ১১ অক্টোবর ২০১৮

দেশের একাডেমিক শিক্ষার সর্বোচ্চ সনদ নিয়েও বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা, চাকরি মিলছে না। স্নাতকোত্তর পাশের পর তিন থেকে চার বছর আবার চাকরির জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। করতে হচ্ছে কোচিংও। তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গলদটা আসলে কোথায়?

অন্যদিকে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কোচিং সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে আছে বাণিজ্য করার দীর্ঘদিনের অভিযোগ। কিভাবে বাণিজ্য থেকে এসব  প্রতিষ্ঠানকে বের করা যায়? কিভাবে শিক্ষাকে নিরেট সেবায় পরিণত করা যায়? কিভাবে তরুণ সমাজের মধ্যে ক্ষয়ে যাওয়া নীতি-নৈতিক জাগ্রত করা যায়?

এসব প্রশ্নের সুলোক সন্ধানে একুশে টেলিভিশন অনলাইন মুখোমুখি হয় অধ্যাপক শফি আহমেদের। যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ ৪১ বছর শিক্ষকতা করেছেন।

দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে তিনি শিক্ষা আন্দোলন, শিক্ষা পদ্ধতির সংস্কার, শিক্ষার্থীদের নানাবিধ সমস্যা ও তরুণ সমাজের বেকারত্ম নিয়ে ছিলেন সরব। বর্তমানে তিনি পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সিনিয়র ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমাদের এ দৃষ্টিভঙ্গি আনতে হবে যে, উচ্চ শিক্ষা নিয়ে চেয়ার-টেবিলের চাকরি করবো। বরং চাকরি ছাড়াও সম্মানজনকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়-এ ধারণা পোষণ করতে হবে।

তিনি বলেন. শুধু যে চাকরিতেই  সম্মান এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিদেশিরা সব ধরণের কাজকে সম্মানের সঙ্গে দেখে। সে কারণে সেখানে বেকার কেউ থাকে না। বাংলাদেশে চাকরি না পেলেই শিক্ষিতরা নিজেকে বেকার ভাবেন। কিন্তু তাকে বুঝতে হবে যে শিক্ষিত হওয়ার মানে এই নয় যে, তাকে চাকরিই করতে হবে। সে সব কাজই করতে পারবে।

দুই পর্বের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম। পাঠকের উদ্দেশ্যে প্রথম পর্বটি আজ তুলে ধরা হলো-

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখেরও বেশি। বিবিএসের রিপোর্ট অনুযায়ী গত এক বছরে আরও ৮০ হাজার বেকার বেড়েছে। দেশের এই বিশাল জনশক্তিকে আমরা কেন কাজে লাগাতে পারছি না? কেন সর্বোচ্চ পর্যায়ের ডিগ্রি নেওয়ার পরও চাকরি মিলছে না? কেন আমরা বেকার থাকছি?

শফি আহমেদ: আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গলদ নিয়ে অনেক আগে থেকেই কথা বলে আসছি। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা দেশ ও দেশের বাইরে প্রশংসিত ও নিন্দনীয় দুটিই হয়েছে।কিছু ভালো দিকের কারণে প্রশংসিত হয়েছে।আবার শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু গলদ রয়ে গেছে, যার কারণে নিন্দনীয় হয়ে আসছে। আমাদের শিক্ষাদান ও গ্রহণের মধ্যে একেবারে মৌলিক ত্রুটি রয়ে গেছে। আর এই ত্রুটির কারণেই আমাদের গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া ছেলে-মেয়েদের জ্ঞান সম্প্রসারিত হচ্ছে না। এ সমস্যা খ্যাতিমান স্কুলগুলোর ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রেও।

আমরা সড়কে যানজট নিয়ে অনেক কথা বলি। অনেক কিছু করি। আমাদের বিশ্লেষকরাও নগর পরিকল্পনার কথা বলতে থাকেন। কিন্তু আসলে যে কি কি ক্ষতি হচ্ছে এ রকম তালিকা তৈরি করে আমরা কথা বলি না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও সেই রকম কিছু মৌলিক ও বাস্তবিক বিষয়ের ঘাটতি আছে।

উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, আমি মেহেরপুরে গিয়েছিলাম একটি স্কুলের ভিজিটে। সেখানে ছেলে-মেয়েদের জিজ্ঞাসা করা হলো শব্দ শক্তি কি? তারা সহজে বইয়ের গদবাধা মুখস্থ উত্তর দিয়ে দিল।কিন্তু যখন জানতে চাওয়া হলো কি করে শব্দ শক্তি তৈরি হয়।এর ব্যবহারিক দিক বল। তখন কেউ উত্তর দিতে পারলো না।বোঝা গেল শিক্ষার্থীরা বইয়ের মুখস্ত বিদ্যায় সীমাবদ্ধ আছে। তাদের জ্ঞান সম্প্রসারিত হয়নি এবং শিক্ষকরাও তাদের জ্ঞান সম্প্রসারণের শিক্ষা দেয়নি। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে প্রতিনিয়ত সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবর্তীত চাহিদা অনুযায়ী আমরা কি আমাদের শিক্ষাকে সাজাতে পেরেছি? পারি নাই। দিন গেলেই প্রযুক্তিগত দিকগুলোর চাহিদা বাড়ছে বিশ্বব্যাপী। আমরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সেটা কতটুকু ঢোকাতে পেরেছি? পরিবর্তীত এ বিষয়গুলি অবশ্যই পাঠ্যবইয়ে আনতে হবে। তবেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কর্মমুখী হবে।

এছাড়া আমাদের মনোভঙ্গির মধ্যে এখনও আছে যে, আমাদের এমএ পাস করতেই হবে। এমএ পাস করলে আমার বাবা ও পরিবার খুশি হয়, আমিও খুশি। আমি মনে করি আমাদের বেকারত্বের বড় কারণ হচ্ছে আমি কি ধরণের কর্ম করতে চাই, কিসের মাধ্যমে আমি আমার জীবনকে গড়ে নিতে পারি, কিসের মাধ্যমে আমি প্রতিষ্ঠিত হতে পারি সেই জায়গাটা স্পষ্ট হওয়া উচিত। সেই স্পষ্টটা শিক্ষার মাধ্যমেই করতে হবে। শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে জানাতে হবে যে প্রতিষ্ঠিত শুধু উচ্চ শিক্ষার মাধ্যমে নয়, কারিগরি জ্ঞান নিয়েও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা যায়। আমাদের এ দৃষ্টিভঙ্গি আনতে হবে যে উচ্চ শিক্ষা বা চেয়ার-টেবিলের চাকরি নয়, অল্প শিখে এবং চাকরি ছাড়াও সম্মানজনকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে বাণিজ্যের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।এ থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষাকে নিরেট সেবায় পরিণত করার মূলমন্ত্র কি হতে পারে? 

শফি আহমেদ: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া প্রাই সবই ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত। তারা কখনও কেউ হয়তো শিক্ষা নিয়ে ভেবেছেন, শিক্ষার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বা তাদের শিক্ষা নিয়ে ভাবনা কোথাও প্রকাশিত হয়েছিল, এমন দাবি থেকেই তারা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে বসেছে।

আমাদের দেশে গুটিকয়েক বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাস আছে। যারা কিছুটা ভালো করছে। বাকিরা সবই তো নামকা অস্তে। তারা ভাড়া বাসায় বিশ্ববিদ্যালয় খুলে বসেছে। ব্যবসায়িক মনোভঙ্গির কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান এমন একটি পর্যায়ে এসেছে যে চাকরিদাতারা তাদের শিক্ষার্থীদের উপর আস্থা রাখতে পারছে না। অর্থাৎ ব্যবসায়িক কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে গিয়ে গ্রেট বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের এ গ্রেট পাওয়া ছাত্র সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বি গ্রেট পাওয়া ছাত্রের মেধার সঙ্গে পেরে উঠছে না।টাকার বিনিময়ে অল্প সময়েই শিক্ষার্থীদের গ্রেট ও সনদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।যে সনদে শিক্ষার্থীরা চাকরির আবেদন পর্যায়েই পিছিয়ে পড়ছে।

কারণ যখন দেখা হয় যে ভালো রেজাল্ট করেও তাদের ভীত দুর্বল। তখন বাছাই পর্ব থেকেই তাদের বাদ দেওয়া হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ গ্রেটিংয়ের কারণে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও আমাদের গ্রেটিং পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। আগে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রেটিং ছিল না।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশে গড়ে ওঠা কোচিংগুলোর বিরুদ্ধে বেপরোয়া বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকেই আবার স্কুলের পাঠ  নেওয়ার চেয়ে কোচিংয়ের শিক্ষাকে গরুত্ব দিচ্ছেন। বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন? 

শফি আহমেদ: আমরা ছাত্র থাকাবস্থায় কোচিং নামক শব্দও ছিল না। কিন্তু এখন শিক্ষার জন্য কোচিং একটা অবিচ্ছেদ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক দিন ধরেই এটা চলছে। এখানেও চলছে এক ধরণের বাণিজ্য। যেখানে মূল শিক্ষার ধারাকে পাল্টে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থলে কোচিংকে বড় করে দেখা হচ্ছে। যার জন্য আমাদের শিক্ষকরাও দায়ী।

শিক্ষকরা মূল প্রতিষ্ঠান স্কুলে পাঠদানে মনোনিবেশ যতটা না হচ্ছে তার চেয়ে বেশি হচ্ছে কোচিংয়ে। কারণ কোচিং থেকে তার বাড়তি আয় হচ্ছে। ফলে কোচিং আর স্কুলের বিষয়টি এখন ডাক বিভাগ আর কুরিয়ার সার্ভিসের মতো হয়ে গেছে। সাধারণ ধারণায় ডাক বিভাগ সেবার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। আর কুরিয়ার সার্ভিস তাৎক্ষণিক সেবা দেওয়ার কারণে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

তাই বলা যায় কোচিং বন্ধে স্কুলের শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের পাঠদানে আন্তরিক হতে হবে। শিক্ষককে নৈতিকতায় ফিরে আসতে হবে। স্কুলের বেতন তুলে কোচিংয়ের সামান্য আয়কে বড় করে দেখলে হবে না। আবার অভিভাবকদেরও কোচিং মুখীতা বন্ধ করতে হবে। মোট কথা  শিক্ষক, অভিভাবক ও সরকার সবাইকে চাইতে হবে যে কোচিং বন্ধ হবে। সরকারকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।

/ এআর /


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি