অনলাইনে ক্লাস নিয়ে ক্যাম্পাসিয়ানদের ভাবনা
প্রকাশিত : ১২:৪২, ২৮ জুন ২০২০
করোনার মহামারিতে আতঙ্কে পুরো বিশ্ব। প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। গত ৩ মাস যাবৎ বন্ধ রয়েছে সব ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যার ফলে শিক্ষাজীবনে নেমে এসেছে মহাসংকট। এই সংকট দূরীকরণে শিক্ষা মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) সকল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
এমতাবস্থায় অনলাইন ক্লাস নিয়ে কী ভাবছেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, এসব নিয়ে লিখেছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশে টিভির সংবাদদাতা আব্দুর রহিম।
আইনুল আজিম জাহিন, বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়
করোনার মহামারিতে থমকে গেছে পুরো পৃথিবী। বন্ধ রয়েছে সব ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আবার কবে খুলবে তা বলাও মুশকিল। সেশনজটের আশঙ্কায় অনিশ্চয়তার দিন পার করছে হাজারো শিক্ষার্থী। এমতাবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার করে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা একটা সমাধান হতে পারে। তবে এই ক্ষেত্রে কিছু বিষয় অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
প্রথমত, সবার সমান সুযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। কেউ যেন নেটওয়ার্ক অসুবিধা জনিত অথবা আর্থিক সংকটের জন্য পাঠদান থেকে বঞ্চিত না হয়। দ্বিতীয়ত, কোনরূপ পরীক্ষা না নেওয়া। কারণ অনলাইনে পরীক্ষা দেওয়ার ডিভাইসও সকলের কাছে সহজলভ্য নয়। তৃতীয়ত, অনলাইন ক্লাসের উপর ভিত্তি করেই সেমিস্টার শেষ না করা, পরবর্তীতে স্বাভাবিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলে অনলাইন ক্লাসের পড়ানো টপিক নিয়ে বিস্তর আলোচনার করা। এছাড়া ল্যাব ক্লাসগুলো এবং ল্যাব নির্ভর কোর্সগুলো অনলাইন ক্লাসের আওতাভুক্ত করা যাবে না।
আবদুল্লাহ আল জোবায়ের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
করোনার মহামারী কখন শেষ হবে, তা বলা মুশকিল। সেশনজট এড়াতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সীমিত আকারে অনলাইন ক্লাস শুরু করলেও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যে সেশনজটে পড়ে গেছে। কারণ, এখনও তারা অনলাইন ক্লাস শুরু করতে পারেনি।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যেসব বিভাগে সেমিস্টার পদ্ধতিতে পাঠদান হয় তাদের মে মাসের শেষে বা জুনের শুরুতে পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। একইসময়ে যাদের ইয়ার সিস্টেম, তাদের কোর্স পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে তাও সম্ভব হয়নি। এই জন্য অনলাইন ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্তকে আমি সাধুবাদ জানাই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনলাইন ক্লাস নেওয়ার সক্ষমতা আছে কিনা তাও দেখতে হবে।
প্রথমত, শিক্ষকেরা অনলাইনে ক্লাস নিতে পারবেন কিনা সেটা বিবেচনায় আনতে হবে আগে। কারণ, শিক্ষক নিয়োগ এবং তাদেরই একটি বড় অংশের ক্লাসে পাঠদান নিয়ে শিক্ষার্থীরা ‘প্রশ্ন’ তোলে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, গতানুগতিক ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস করা সম্ভব না। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মোবাইল অপারেটরগুলোর সাথে চুক্তি করে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের সুবিধার্থে জুম, স্কাইপ প্রভৃতি অ্যাপের মাধ্যমে ফ্রি সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। অথবা মোবাইল অপারেটরগুলোর সাথে চুক্তি করে শিক্ষার্থীদের জন্য নিম্নমূল্যে ইন্টারনেট সুবিধা নিশ্চিত করা।
তারেক আজিজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রচারণায় ডিজিটাল বাংলাদেশ হলেও বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট এখনও অনলাইন ক্লাসের উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। আমি কুষ্টিয়া জেলার একটি প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করি। এখানের সবার ঘরে এখনো স্মার্টফোন পৌঁছায়নি। কোনভাবে যাদের স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্য হয়েছে তাদের সবাই উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন না। নেটওয়ার্ক পাওয়া গেলেও সবার ইন্টারনেট প্যাকেজ কেনার সামর্থ্য নেই। দেখা যাবে একমাস অনলাইনে ক্লাস করতে হলে অন্ততপক্ষে দেড় থেকে ২ হাজার টাকার ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনতে হবে। যেটা নিঃসন্দেহে অনেকের ক্ষেত্রেই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এদিকে চলতি বাজেটে আরও ১০% ভ্যাট বাড়িয়ে ২৫% করা হয়েছে।
যদি অনলাইন ক্লাস ছাড়া কোন বিকল্প পথ না থাকে সেক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের জন্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ইন্টারনেট প্যাকেজ নিশ্চিত করতে হবে অথবা সারাদেশে ব্রডব্যান্ড সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমাদের কোর্সের বড় একটা অংশ ল্যাবরেটরিতে করতে হয়। অনলাইনে কোনভাবেই ব্যবহারিক জ্ঞান লাভের সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু হাতে কলমে শেখার প্রতিষ্ঠান তাই এখানে অনলাইনে পুরোটা শেখা কোনভাবেই সম্ভব না।
সাইফুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
অনলাইন ক্লাসের দ্বারা কিছু সংখ্যাক শিক্ষার্থী উপকৃত হলেও বেশিরভাগই ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে আমি মনেকরি। কারণ অনলাইনে ক্লাসের অনেক জটিলতা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী করোনার কারণে এখন গ্রামে অবস্থান করছে। আর গ্রামে ইন্টারনেট খুবই মন্থর গতির। অনায়াসে কথা বুঝা যায়না এবং কিছু শিক্ষার্থী এমনও আছে যাদের পক্ষে নেট খরচ বহনও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তাই অনলাইনে ক্লাসে শহরের কিছু এলিট শ্রেণির শিক্ষার্থীরা উপকৃত হলেও গ্রামের শিক্ষার্থীরা এতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তারা ক্লাসগুলো মিস করবে এবং ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বিনামূলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট দেয়ার যে উদ্যোগ গ্রহণ করছে এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে সেটা বাস্তবায়ন করা কতটুক সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
মোয়াজ্জেম আফরান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
করোনায় বিপর্যস্ত দেশের শিক্ষাখাত। তিন মাসের অধিক সময় ধরে বন্ধ রয়েছে সব ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তবে কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তা বলা মুশকিল। ফলে প্রকট হচ্ছে সেশন জটের আশঙ্কা। ইতিমধ্যে এ আশঙ্কা থেকে উত্তরণে ইউজিসি সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস চালু করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলছে। এ সিদ্ধান্তকে ‘মন্দের ভালো’ বলা যায়। কারণ বাড়িতে অলস বসে থাকার চেয়ে কিছুটা হলেও পড়াশোনা চর্চায় থাকা ভালো। তারপরও অনেক শঙ্কা থেকেই যায়। কেননা অনলাইন ক্লাস ব্যবস্থায় শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত ও ডিজিটাল অপর্যাপ্ততা নিয়ে বিভিন্নভাবে প্রশ্ন উঠছে।
প্রথমত, আমাদের ভৌত ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর অপ্রতুলতা, দুর্বল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা, প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যয়বহুল, অধিকাংশ শিক্ষার্থীর আর্থিক সক্ষমতা নেই। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে আমাদের চারপাশে এক অদ্ভূত অনিশ্চয়তা ভর করছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের আর্থিক অবস্থার পাশাপাশি মানসিক বিপর্যস্ততা বাড়তি বিড়ম্বনা সৃষ্টি করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক শিক্ষার্থী পরিবার নিয়ে খেয়েপরে বাঁচতেই হিমশিম খাচ্ছে। মূলত এসব কারণেই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ৩৫-৪০% শিক্ষার্থী ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না।
সাবিহা তাসমিম, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশে করোনা মহামারির তীব্রতা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে । তবে এই সংকটকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। বিগত ৩ মাসের অধিক সময় ধরে লকডাউনে বাসায় থাকার কারণে অনেক শিক্ষার্থী মানুসিক দুশ্চিন্তায় ভুগছে। সেক্ষেত্রে মহামারি সংকট কবে শেষ হচ্ছে তাও অনিশ্চিত। এখান থেকে উত্তরণের জন্য বিকল্প পথ খুঁজে বের করা অতি অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে । অপরদিকে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুর্বল নেটওয়ার্ক, ডাটার অতিরিক্ত মূল্য ইত্যাদি কারণে অনেকেই অনলাইনে ক্লাসে যুক্ত হতে পারবে না। সেক্ষেত্রে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টারনেট খরচ সর্বনিম্ন করে সকল শিক্ষার্থীদের মাঝে ইন্টারনেট সেবা পর্যাপ্ত করার বিষয়ে সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি।
আহসান জোবায়ের, জগ্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
স্বাভাবিকভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাসের যৌক্তিকতা নেই বরং এটি বৈষম্যমূলক। শিক্ষার্থীদের কাছে ভালো নেটওয়ার্ক সুবিধা নেই, স্মার্ট ডিভাইসও সবার কাছে নেই। যাদের সামর্থ আছে তারা অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে পারবে আর যাদের সামর্থ নেই তারা যোগ দিতে পারবে না। এতে করে ‘সামর্থবান ও সামর্থহীন’ দুটি শ্রেণি বৈষম্য তৈরি হবে। তবে পরিস্থিতিতে যেভাবে অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে, অনলাইনে ক্লাস নেয়া গেলে ভালো হতে, আমাদের এই সময়টা নষ্ট হতো না। অনলাইনে ক্লাস নিলে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়বে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা। অনলাইনে তো আর ল্যাব করা সম্ভব না, ল্যাব ছাড়া কিছু বুঝবেও না। অনলাইন ক্লাসে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা হয়রানির শিকার হবেন। আমাদের শিক্ষকদেরও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই অনলাইন ক্লাসের।
আর করোনার প্রভাবে ক্ষতিটা তো সর্বপরি অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি- বৈশ্বিকভাবে সবকিছুরই হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এই ক্ষতিটা সবার মেনে নিতেই হবে। শিক্ষিত বেকার তৈরি করে বরঞ্চ আমাদেরই ক্ষতি।
শাহাদাত বিপ্লব, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কবে কমবে সে বিষয়ে কেউ বলতে পারছে না। এটা নিশ্চিত যে, খুব দ্রুত করোনা থেকে আমরা মুক্তি পাচ্ছিনা। সেক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদেরকে ভিন্ন উপায় বের করতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে কিন্তু পড়ালেখা থেমে নেই। আমাদের দেশের স্বায়ত্বশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস শুরুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি করে ফেলেছে। আমার মনে হয় খুব দ্রুত অনলাইন ক্লাস শুরু করা উচিৎ।
হ্যাঁ, এটা ঠিক কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। অনেক শিক্ষার্থীই নেটওয়ার্ক সমস্যা বা খরচ বহনের সামর্থ্য না থাকায় অনলাইন ক্লাসে আসতে পারবে না। তাই বলে বসে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। যেসকল শিক্ষার্থীদের সমস্যা হবে তাদেরকে শিক্ষক এবং সহপাঠীরা পিডিএফ, স্লাইড,হ্যান্ডনোট দিয়ে সহযোগিতা করতে হবে।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি খোলা থাকতো তাহলে পরিবহণ খাত এবং উন্নয়ন খাতে কিন্তু বিশাল একটা ব্যয় প্রশাসনকে বহণ করতে হতো। যেহেতু এ খরচটা এখন নেই, তাই তা বিশ্ববিদ্যলয় শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে ব্যয় করে অনলাইন ক্লাস চালু করতে পারে।
এআই//
আরও পড়ুন