সুবর্ণজয়ন্তীতে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে অস্থায়ী সরকার
প্রকাশিত : ২৩:৫০, ২৪ মার্চ ২০২১
‘‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার,
সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার।’’
বিখ্যাত গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবুর সৃষ্টিকে সম্মান জানিয়ে বলতে চাই, বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আজ সর্বোচ্চ সম্মানের সঙ্গে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। যা আমাদের সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে বড় অহংকারের, বড় আবেগের, বড় গৌরবের। তবে এ অহংকার, গৌরব নিমিষেই আমাদের হাতে এসে ধরা দেয়নি। স্বার্থমগ্ন বেনিয়া শাসকেরা সহজে কোনো জাতিকে স্বাধীনতা দান করে না, বহুকষ্টে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে তা ছিনিয়ে আনতে হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতন ও নিপীড়ন এক পর্যায়ে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। তখনই পূর্ব বাংলার মানুষ জাত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
মহান মুক্তিযুদ্ধের বারতা যে বয়ে এনেছিল তিনি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তখন পশ্চিম পাকিস্তানে কারাবন্দী। আর তখনই আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায় মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য যোগ্য ও সুসংগঠিত নেতৃবৃন্দের। যাঁরা তাদের নেতৃত্বের গুণাবলী ও দক্ষতা দিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার বিজয় পতাকা উত্তোলন করতে পারবে।
পূর্ব বাংলার তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনা করে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই গঠন করা হয়— স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার, যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। এটি অস্থায়ী সরকার বা প্রবাসী সরকার নামেও পরিচিতি লাভ করে। ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল আওয়ামী লীগের প্রধান নেতৃবৃন্দদের নিয়ে অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে, তাঁর অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি অর্থাৎ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পদে সৈয়দ নজরুল ইসলাম দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন তাজউদ্দীন আহমদ। এছাড়াও অস্থায়ী সরকারের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান প্রমুখ।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে নানা জমকালো আয়োজনের মধ্যদিয়ে পালিত হচ্ছে আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। তবে ভিন্ন চিত্র লক্ষ্য করা যায়, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে। দু’পৃষ্ঠের এই মূল ফটকের একপাশে সসম্মানে স্থান পেয়েছে অস্থায়ী সরকার অন্যপাশে রণাঙ্গণের সেক্টর কমান্ডারদের প্রতিকৃতি যা কিনা বাংলাদেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রথম।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে স্থান পেয়েছে অস্থায়ী সরকার। একজন সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে মহৎ এই উদ্যোগটিকে আপনি কীভাবে দেখছেন? জানতে চাওয়া হয় গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সোহাইনুল আরেফিন সেতুর কাছে। তিনি বলেন, 'অস্থায়ী সরকার শব্দটির চেয়ে বাংলাদেশের "১ম" সরকার বলাতেই আমি বেশি আগ্রহ প্রকাশ করি। নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এ সরকারের গুরুত্ব ছিল অনস্বীকার্য, এ কথা সকলেরই জানা। '৭১ সালের সেই উত্তাল সময়ে মাতৃভূমির বীর সন্তানেরা অস্থায়ী সরকারের দিক নির্দেশনা মেনে কাজ করে গেছেন। বর্তমান সময়ে যখন "মুক্তিযুদ্ধের চেতনা" শুধুই নিছক এক শব্দযুগলে পরিণত হয়ে পড়েছে দিনে দিনে সেখানে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে তাদের স্থানকে আমি আন্তরিকভাবে সাধুবাদ ও স্বাগত জানাই। আর কিছু না-ই হোক শিক্ষার্থীরা অন্তত তাদের ছবি দেখে মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আগ্রহী হবে এবং এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও বিশুদ্ধ ইতিহাস সকলের মাঝে ছড়াবে এই প্রত্যাশাই রাখি।'
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এবং দেশ ও বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা ও সমর্থন আদায় করার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে অস্থায়ী সরকার। কিন্তু রণাঙ্গণে যাঁদের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ দেশকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারগণ। অথচ বর্তমান প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বারতা বয়ে আনা এ স্বাধীনতা সৈনিকদের অস্তিত্ব প্রায় অতলে নিমজ্জিত।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সমগ্র বাংলাদেশকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এই ১১ টি সেক্টরে কমান্ডার হিসেবে নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে— খালেদ মোশারফ, কে এম শফিউল করিম, সি আর দত্ত, মীর শওকত আলী, উইং কমান্ডার বাশার, কাজী নুরুজ্জামান, ওসমান চৌধুরী, জিয়াউর রহমান, মেজর জলিল, (১০ নং সেক্টরে কোনো সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত ছিলেন না), কর্নেল তাহের। এছাড়াও কোনো কোনো সেক্টরে একের অধিক সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে অস্থায়ী সরকারের পাশাপাশি জাতির বীর সৈনিক সেক্টর কমান্ডার'রা স্থান পেয়েছেন সসম্মানে। এমন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে আপনি কতটা সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করছেন? জানতে চাওয়া হয় গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার কলির কাছে। তিনি বলেন, 'আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনে যারা রণাঙ্গনের সৈনিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তাদের স্মৃতি স্বাধীনতার অর্ধশত বছরে এসেও কেমন যেন মলিন হয়ে পড়েছে। অথচ তৎকালীন সময়ে যাদের সাহসী বুদ্ধিমত্তা, দৃঢ় মনোবল এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত গণ বিশ্ববিদ্যালয়। যা এখনো পর্যন্ত অত্যন্ত নিষ্ঠা এবং সম্মানের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠান তার দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। শুরু থেকেই বাংলা ভাষা, বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে মাতৃক্রোড়ে লালন-পালন করে আসছেন এই গৌরবদীপ্ত প্রতিষ্ঠানটি। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রজন্মের দাবি মাথায় রেখে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে অস্থায়ী সরকারের পাশাপাশি সেক্টর কমান্ডারদের সসম্মানে স্থান এমন সময়োপযোগী পদক্ষেপ সত্যিই প্রশংসনীয়। যা কিনা বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এক রোল মডেল হয়ে থাকবে।'
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনয়নে যাঁরা গৌরবদীপ্ত সংগ্রামের পদচিহ্ন রেখে গেছেন আমাদের হৃদয়ে। তাদের স্মৃতিকে অম্লান রাখতে যে মহৎপ্রাণ মানুষেরা সংগ্রাম করে চলেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে দুপৃষ্ঠে জায়গা পাবে অস্থায়ী সরকার ও সেক্টর কমান্ডেরদের প্রতিকৃতি এমন চিন্তা আসলো কীভাবে? জানতে চাইলে, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ট্রাষ্টি এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্থায়ী সরকারের বিরাট ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই। তারা দেশের জন্য যা করে গেছেন তার জন্য তাদের সব সময় সম্মান জানানো উচিৎ। আমরা তাদের সম্মান জানাতে চেষ্টা করেছি। তাই আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে তাদের প্রতিকৃতিও স্থাপন করেছি। আমরা কী আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের অবদান কীভাবে অস্বীকার করতে পারি! দেশবাসী যেন তাদের সম্পর্কে জানতে পারে, তাদের দেখতে পারে, তাই তাদের প্রতিকৃতিও আছে আমাদের এই মূল ফটকে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলফটকের পাশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করা হবে উল্লেখ করে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আরো বলেন, “আমি বঙ্গবন্ধু দেখেছি, তিনি ছিলেন উদার মনের। আপনারা তাকে সব জায়গায় যেভাবে উপস্থাপন করছেন এভাবে বঙ্গবন্ধুকে ছোট করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে সঠিক ভাবে জানতে হবে। আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে দশ বছর আগে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করেছি। এতে শিক্ষার্থীরা তাকে দেখার সুযোগ পেয়েছে, জানার সু্যোগ পেয়েছে। এখন তার প্রতিকৃতি মূল ফটকের পাশে স্থাপন করা হবে, এতে সবাই তাকে দেখার ও জানার সু্যোগ পাবে।”
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা তরুণ সমাজকে সঠিক ইতিহাস জেনে সংকীর্ণতা মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান।
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবদীপ্ত ইতিহাসও যে সৌন্দর্য ও সাম্যের প্রতীক হতে পারে এবং যা বর্তমান প্রজন্মকে আবেগ, উচ্ছ্বাস, আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ, বিহ্বলতা ও মুগ্ধতার স্পর্শে যথাযথ জ্ঞান দান করতে পারে, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন উদ্যোগ তার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এ যেন এক অনন্য প্রগতির মাইলফলক। যে প্রগতির প্রেরণার দ্বারাই নির্মিত হবে দেশের সকল মানুষের মধ্যে সাম্য, মৈত্রী ও সোহার্দ্যের মেলবন্ধন।
লেখকঃ শিক্ষার্থী- ভাষা-যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।
এসি
আরও পড়ুন