ঢাকা, বুধবার   ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪

শিক্ষার্থীদের ‘ডিভাইস আসক্তি’ থেকে মুক্তি কোন পথে?

মাহতাব মিনহাজ

প্রকাশিত : ২১:৩২, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ | আপডেট: ০৯:০১, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দেড় বছর পর স্কুল-কলেজ খোলায় অভিভাবকদের মধ্যে কিছুটা শঙ্কা কাজ করলেও বন্ধু আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চিরচেনা আঙ্গিনায় ফিরতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে শিক্ষার্থীরা।

মহামারীর মধ্যে শিক্ষার্থীদের ঘরবন্দি জীবনে যেন সব রঙ ফিকে হয়ে গিয়েছিল। দিনের একটা সময় তাদের কেটেছে মোবাইল, ট্যাব কিংবা কম্পিউটারে বসে অনলাইন ক্লাস করে। এরপর সারাদিন ঘুরেফিরেই কোনো না কোনো ডিভাইসে বুঁদ হয়ে থাকা, খাওয়া আর ঘুম।

বদলে যাওয়া জীবনের প্রভাব, বিশেষ করে মোবাইল কিংবা যেকোনো ধরনের ডিভাইসের প্রভাব শিশুর শরীর-মনে ফেলেছে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ।

ঢাকার বেশ কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, মহামারী শুরুর আগে তাদের সন্তানরা মোবাইল কিংবা ট্যাব, কম্পিউটারে খুব একটা বসার সুযোগ না পেলেও মহামারীর সময়ে ঘরে থাকার সময় তারা সেগুলোর ব্যবহারই শুধু রপ্ত করেনি, রীতিমত আসক্তও হয়ে গেছে। কোনো কোনো পরিবারের অবস্থা এতটাই নাজুক যে, সন্তানকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছেও ছুটতে হচ্ছে তাদের।

 

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক শিশু বিশেষজ্ঞ সৈয়দ আহসান তৌহিদ একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, “আমার কাছে অনেক মা-বাবাই সন্তানের শারীরিক বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে আসেন, কিন্তু তাদের প্রধান অভিযোগ থাকে সন্তানের ডিভাইস আসক্তি নিয়ে। বিশেষ করে অনলাইন ক্লাস শুরু হওয়ার পর এই অভিযোগগুলো বেশি বেশি আসছে।”

তেজগাঁও সরকারি গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক রেবেকা সুলতানা বলেন, “যেকোনো জিনিসেরই ভালো দিক মন্দ দিক থাকবে। করোনা মহামারীতে শিক্ষার্থীদের স্কুলে আনতে পারিনি, তাই তাদের একেবারে বসিয়ে না রেখে আমরা অনলাইন ক্লাসগুলো নিয়েছি। এতে ডিজিটালি তারা কিছুটা উন্নতি করেছে।”

তিনি আরো বলেন, “যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেরই একটা খারাপ প্রভাব থেকে যায়, এটাকে মোকাবেলা করতে গিয়ে আমরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, আমাদের বাচ্চারাও হয়েছে।”

প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের অবস্থা জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুরের চরবসু এস ই এস ডি পি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান মানিক বলেন, “গ্রামাঞ্চলের অনেক পরিবার ছিল যাদের ঘরে কোনো অ্যান্ড্রয়েড ফোন ছিল না। অর্থ সংকটের মধ্যেও অনলাইনে ক্লাসের জন্য সন্তানের হাতে বাধ্য হয়ে ফোন তুলে দেন অভিভাবকরা। কিন্তু দেখা যায়, ক্লাসের পরও কোমলমতি শিক্ষার্থীরা নেট ব্রাউজিং করে এবং ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়ে।

“সন্তানের কাছ থেকে মোবাইল উদ্ধার করা অভিভাবকদের পক্ষে এখন কষ্টকর হয়ে পড়েছে। অভিমানী সন্তানদের কাছে তারা অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছেন বলে জানা গেছে। একসময়ের পাড়ার খেলাধুলার পরিবর্তে এখন দলবদ্ধ হয়ে মোবাইল গেমিং করতে দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের।”

শিক্ষক-বিশেষেজ্ঞরা যা বলছেন,

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্কুল-কলেজ খোলার পর শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিকতায় ফিরতে সময় দিতে হবে। অভিভাবক, শিক্ষকদের সহয়তায় উদ্দীপনা বা প্রেরণাদায়ী (মোটিভেশনাল) কার্যক্রমের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তাদের যন্ত্রের প্রতি আসক্তি কাটাতে হবে।     

তেজগাঁও সরকারি গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক রেবেকা সুলতানা শিক্ষার্থীদের মোবাইল কিংবা অন্য যেকোনো ডিভাইসের প্রতি আসক্তি দূর করতে উদ্দীপনামূলক কর্মকাণ্ডের কথা বলেছেন।

তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়েছে সেটা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করব। তাদেরকে আমাদের বোঝাতে হবে অনলাইনে তারা যদি পাঁচ ঘণ্টা বা তার অধিক সময় থাকে তাহলে তাদের ব্রেইনের টিস্যু শুকিয়ে যেতে পারে। এভাবে নানা রকম মোটিভেশন দিয়ে তাদেরকে আবার ক্লাসে মনোযোগ ফেরানোর চেষ্টা করব।”

একই ধরনের পরামর্শ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কায়কোবাদের। 

শিক্ষার্থীদের আবার কিভাবে বইয়ের পাতায় মনোযোগী করা যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন নতুন জিনিসের প্রতি আসক্ত হয়েছে, বাবা-মা হিসেবে আমাদের সেগুলো দেখা উচিত। ছেলে মেয়েরা যাতে অধিক সময় স্ক্রিনে না থাকে এবং তাদেরকে আস্তে আস্তে বুঝিয়ে শুনিয়ে ডিভাইস আসক্তি থেকে বের করে ক্লাসে মনোযোগী করে তুলতে হবে।”

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট হাসপাতালের সাবেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাক্তার তাজুল ইসলাম বলেন, “কোনোভাবেই অনলাইনে পড়াশুনা স্বভাবিক সময়েও সঠিক পদ্ধতি নয়। যেহেতু শিশুদের অনলাইনে আসক্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে, সেহেতু তাদেরকে এই সুবিধা দেওয়া ঠিক হয়নি। এ কারণে অবশ্যই তারা ডিভাইসে আসক্ত হয়ে গেছে এবং লেখাপড়াসহ সব ধরনের সৃজনশীলতা থেকে দূরে সরে গেছে। 

“এখন তাদেরকে আবার বাস্তব জীবনে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য সামগ্রীকভাবে ধীরে ধীরে আমাদেরকে পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদেরকে লেখা-পড়া, খেলাধুলা, বিনোদনসহ বিভিন্ন সৃজনশীল চর্চার মধ্য দিয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে।”

তবে শুধু যে অনলাইন ক্লাস করতে গিয়েই শিশুরা ডিভাইসের প্রতি আসক্ত হয়েছে, তা মানতে নারাজ তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষক রাকিব আহমেদ।

তিনি বলেন, “ডিভাইস আসক্তিটা আসলে তাদের অনলাইন ক্লাসের জন্য হয়নি, বরং ডিভাইসের সহজলভ্যতার কারণে ক্লাসের কথা বলে বাবা-মায়ের অজান্তে গেমিংসহ অন্যান্যভাবে ডিভাইসের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে তারা।

“একজন শিক্ষার্থী স্কুলে সাত থেকে আট ঘণ্টা থাকলে তার মানসিক ও শারীরিক চর্চা হয়। ঘরে থেকে তাদের যে ডিভাইস আসক্তি হয়েছে তা কমানোর জন্য সৃজনশীল অন্য কোনো ব্যবস্থা নিতে হবে।”

শিক্ষার্থীদের ডিভাইস আসক্তি দূর করতে সরকারের কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম বলেন, “আমরা শিক্ষা বিভাগকে বিভিন্ন গাইডলাইন দিয়েছি এবং অনেক সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করেছি।”

এমএম/ এএইচএস//আরকে


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি