সহপাঠীদের বর্ণনায় বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যা
প্রকাশিত : ১৩:৪৮, ৭ অক্টোবর ২০১৯ | আপডেট: ১৪:২৪, ৭ অক্টোবর ২০১৯
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার বর্ণনা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শের-ই-বাংলা হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা।
এই হত্যার সঙ্গে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন ওই হলের শিক্ষার্থীরা।
জানা যায়, নিজ ফেইসবুকে প্রফাইলে চলমান ভারত-বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে স্ট্যাটাস দেওয়ায় তাকে শিশির আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা।
এ ঘটনায় সোমবার সকালে বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ও সহ সভাপতি ফুয়াদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে বলে চকবাজার থানার ওসি সোহরাব হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা জানান, রোববার রাত আটটার দিকে আবরার ফাহাদসহ দ্বিতীয় বর্ষের ৭-৮ জন শিক্ষার্থীকে শের–ই–বাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে পাঠান তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ৭/৮ জন নেতা। তারা আবরার ফাহাদের মুঠোফোন ঘেটে শিবির-সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ খোঁজেন। এক পর্যায়ে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে তাকে পেটাতে শুরু করেন ছাত্রলীগের নেতারা। পরে চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী ওই কক্ষে গিয়ে আবরারকে আরেক দফায় পেটান।
আবরারের বিরুদ্ধে শিবির-সংশ্লিষ্টতার কিছু প্রমাণও পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আশিকুল ইসলাম ওরফে বিটু। তিনি ২০১১ নং কক্ষে ঘটনার রাতে আবরারের সঙ্গে কথা বলেছেন।
আশিকুল ইসলাম ওরফে বিটু বলেন, ‘রাত আটটার দিকে আবরার ফাহাদকে ২০১১ নম্বর কক্ষে ডাকা হয়। আমি মাঝে মাঝে ওই কক্ষে বন্ধুর কাছে যাই। গতকাল রাতে গিয়ে দেখতে পাই, সেখানে আবরার ফেইসবুক আইডি ও মেসেঞ্জার চেক করা হচ্ছে। তাঁর বিরুদ্ধে শিবির-সংশ্লিষ্টতার কিছু প্রমাণও পাওয়া যায়। রাত পৌনে নয়টার দিকে আমি কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসি। পরে সেখানে কী হয়েছে, আমি জানি না ৷ নিজের কক্ষে গিয়ে পড়াশোনা ও আড্ডা দিয়ে রাত একটার দিকে ওই কক্ষে রেখে আসা নিজের ল্যাপটপ ও বই আনতে গেলে আবরারকে পড়ে থাকতে দেখি। তখন সেখানে আর কেউ ছিল না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হলের শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন। সোমবার রাত তিনটার দিকে হলের সিঁড়ির কক্ষ থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
হল শাখা ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, আবরারকে জেরা ও পেটানোর সময় ওই কক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আইন বিষয়ক উপ-সম্পাদক ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র অমিত সাহা, উপ-দপ্তর সম্পাদক ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র মুজতাবা রাফিদ, সমাজসেবা বিষয়ক উপ-সম্পাদক ও বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ইফতি মোশারফ ওরফে সকালসহ তৃতীয় বর্ষের আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী ছিলেন৷
ওই কক্ষে এসে দ্বিতীয় দফায় আবরারকে পেটান বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অনিক সরকার, ক্রীড়া সম্পাদক ও নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একই বর্ষের মেফতাহুল ইসলাম জিয়নসহ কয়েকজন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘পেটানোর পর আবরারের মৃত্যু হলে রাতে তাঁর সহপাঠীদের ডেকে লাশ নিচতলার সিঁড়ির সামনে রাখা হয়।’
মৃত আবরার ফাহাদ বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁর বাড়ি কুষ্টিয়া শহরে।
হলের দারোয়ান মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, ‘সিঁড়ির পাশের সিসিটিভি ফুটেজটি নষ্ট। কোনো আওয়াজ বা হইচই শুনিনি৷ এই অংশের সিসিটিভি কয়েক দিন থেকে এলোমেলো।’
ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় শের-ই-বাংলা হলে গিয়ে দেখা যায় হল ক্যান্টিনে আবরারের লাশ রাখা। আবরারের সহপাঠীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলেও তাঁরা কিছু বলতে রাজি হননি। কিছুক্ষণ পর হলের সিসিটিভি ফুটেজ শিক্ষার্থীদের সামনে দেখানো হলেও রাত ২টা ৬ মিনিটের পর সিসিটিভি ফুটেজে কী রয়েছে, তা দেখানো হয়নি। যে কক্ষে (২০১১ নম্বর) আবরারকে পেটানো হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেখানে গিয়েও কাউকে পাওয়া যায়নি।
ঘটনার বিষয়ে হল প্রাধ্যক্ষ জাফর ইকবাল খান বলেন, ‘রাত পৌনে তিনটার দিকে খবর পাই যে এক শিক্ষার্থী হলের সামনে পড়ে আছেন। কেন সে বাইরে গিয়েছিল, কী হয়েছিল, তা এখনও জানা যায়নি। তাৎক্ষণিকভাবে বুয়েটের চিকিৎসক দিয়ে তাঁকে পরীক্ষা করা হয়। ঐ চিকিৎসক জানান তিনি বেঁচে নেই। পরে পুলিশকে খবর দিই। পুলিশ এসে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।
বুয়েটের চিকিৎসক মাশরুক এলাহী বলেন, ‘খবর পেয়ে তিনটার সময় ঘটনাস্থলে আসি। এক তলা ও দোতলার মাঝামাঝি জায়গাতে আবরারকে পড়ে থাকতে দেখি। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বুঝতে পারি ছেলেটি বেঁচে নেই। কী কারণে আবরারের মৃত্যু হয়েছে এমনটি জানতে চাইলে মাশুক এলাহী বলেন, ‘আঘাতজনিত কারণে সে মারা গেছে। সেই সম্ভাবনাই বেশি।’
চকবাজার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘রাত পৌনে ৩টার দিকে আমরা খবর পাই যে, শের-ই বাংলা হলের বাইরে নিচতলায় ছেলেটা পড়ে আছে। তার শরীরে আঘাত রয়েছে। কোনো কিছু দিয়ে বাড়ি দেওয়া হয়েছে। লাশের ময়নাতদন্ত হবে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
এদিকে আবরারের হত্যার বিচারের দাবিকে সকাল থেকেই শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছে বুয়েট। এ ঘটনায় সকাল থেকেই সিসিটিভির ফুটেজ উদ্ধারের দাবিতে প্রভোস্টের অফিস ঘেরাও করেন শিক্ষার্থীরা। সিসিটিভির ফুটেজ চেক করতে গিয়ে দেখা যায় রাত ২টা ৬ মিনিটের পর থেকে সিসিটিভির ফুটেজ পাওয়া যাচ্ছে না।
এমএস/
আরও পড়ুন