গলাকাটা ভর্তি ফি নিচ্ছে নবাবগঞ্জের সেন্ট ইউফ্রেজীস!
প্রকাশিত : ১৬:০৮, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯

সন্তানরা পাস করে নতুন ক্লাসে ওঠা যেকোনো বাবা-মায়ের জন্য সীমাহীন আনন্দের। তবে ঢাকার নবাবগঞ্জের সেন্ট ইউফ্রেজীস গালর্স স্কুল এন্ড কলেজে পড়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের বেলায় এই চিত্রটি বিপরীত!
সন্তান পাস করে নতুন ক্লাসে ওঠার খবর পেলে অভিভাবকদের কপালে চিন্তার রেখা ভেসে ওঠে। কারণ এসব স্কুলে নতুন শ্রেণিতে ওঠা মানে শ্রেণিবদলের জন্য হাজার হাজার টাকা ঢালতে হয়। একজন শিক্ষার্থী তার নিজের স্কুলেই নতুন ক্লাসে উঠতে ‘ভর্তি ফি’র নামে কেন এত টাকা দিতে বাধ্য হবে তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই।
ফলে শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে অনেক অসচ্ছল পরিবারের শিশুদের। এ নিয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও তা কেউই মানছে না। শিক্ষা প্রশাসন এ বিষয়ে এখনও নির্বিকার।
ঢাকার নবাবগঞ্জে ভর্তি ফি বার্ণিজ্যে এবারও এগিয়ে রয়েছে হাসনবাদে অবস্থিত সেন্ট ইউফ্রেজীস গালর্স স্কুল এন্ড কলেজ।
৯ম ও ১০ম শ্রেণিতে এ উপজেলার খানেপুর উচ্চ বিদ্যালয় ২০৫০ টাকা, বারুয়াখালী উচ্চ বিদ্যালয় ২২২০ টাকা, কলাকোপা কোকিলপ্যারী উচ্চ বিদ্যালয় ১৭৫০ টাকা ভর্তি ফি নিচ্ছেন। ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত আরো কম নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
সেখানে একই উপজেলার সেন্ট ইউফ্রেজীস গালর্স স্কুল এন্ড কলেজ হাতিয়ে নিচ্ছে ৬ হাজার ৬৫০ টাকা। এছাড়া বান্দুরা হলিক্রশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভর্তি ফি আদায় করছে প্রায় ৫ হাজার টাকা। অথচ উপজেলা শিক্ষক সমিতি থেকে ২ হাজার ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সেন্ট ইউফ্রেজীস গালর্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের শতাধিক অভিভাবক প্রতিষ্ঠানটির সামনে অপেক্ষা করছেন। ভিতরে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন বেতন রশিদ সংগ্রহ করছে। রশিদে জানুয়ারি মাসের বেতন বাবদ ৪৫০ টাকা এবং ভর্তি বাবদ ৬ হাজার ২০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। তবে ৬ হাজার ২০০ টাকা কি কি খাতে নেওয়া হচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোট ৬ হাজার ৬৫০ টাকা আদায় করছে বিদ্যালয়টি।
বিদ্যালয়ের প্রায় শতাধিক অভিভাবক অতিরিক্ত ভর্তি ফি’র ব্যাপারে বিদ্যালয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন বলে জানা যায়। তবে বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সিস্টার মেবেল কস্তা অভিভাবকদের সঙ্গে দেখা না করে প্রশাসনের শরণাপন্ন হন। এসময় পুলিশ এসে বিদ্যালয়ের অভিভাবকদের সরিয়ে দেন।
এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে অভিভাবকরা বলেন, আমরা এসেছিলাম বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু তিনি অভিভাবকদের সঙ্গে দেখা না করে উল্টো পুলিশ ডেকে এনে অভিভাবকদের অপমান করেছেন। পরে অভিভাবকরা নবাবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর একটি স্মারকলিপি দেন।
অভিভাবকদের অভিযোগ, কেউ কেউ ধার-দেনা করে এই টাকা জমা দিয়ে ভর্তি করাতে পারলেও বেশিরভাগই এসব ফি থেকে অব্যাহতি পাওয়া কিংবা কিছুটা কমানোর জন্য ধর্না দিচ্ছেন দ্বারে দ্বারে। অনেক অভিভাবক কিছুটা ফি কমানোর জন্য প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তারা সাক্ষাৎ দেন না।
হাসনাবাদ গ্রামের কুসলুম বেগম বলেন, আমার স্বামী দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালায়। মেয়ে ৯ম শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণিতে উঠেছে। নতুন করে ভর্তি হতে হবে এর জন্য সাড়ে ৬ হাজারের উপরে টাকা চাচ্ছে। বাধ্য হয়ে একজনের কাছ থেকে ঋণ করে টাকা আনতে হলো। মেয়েটাকে তো পড়াতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক অভিভাবক অভিযোগ করে বলেন, অনেক দরিদ্র পরিবারের সন্তানরাও এই বিদ্যালয়ে পড়ে। সিস্টারের কাছে টাকা কমাতে গেলে তিনি তো টাকা কমান না উল্টো আজেবাজে কথা বলেন। ভর্তি করাতে না পারলে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিন, অন্য স্কুল ভর্তি করান এমন কথাও শুনতে হয় সিস্টারদের মুখ থেকে।
এক হিসাবে দেখা গেছে, বছরের শুরুতেই বিদ্যালয়টি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করে অর্ধকোটি টাকার উপরে। এছাড়া সারাবছর বেতনসহ আনুসাঙ্গিক খরচ তো আছেই। বছরের ১২ মাসই বেতনের সঙ্গে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে কয়েকজন অভিভাবক বলেন, শিশুরা পাস করার পর স্কুলগুলো যা করছে তা তাদের শিক্ষাজীবনকে ‘জিম্মি’ করে টাকা আদায় ছাড়া আর কিছু নয়। সরকারি স্কুলে সবাই ভর্তি হতে পারে না। আর এসব স্কুলে ভর্তি করিয়ে অভিভাবকদের বেতন দেয়ার সক্ষমতা থাকলেও বছরের প্রথমে এই গলাকাটা ফি’র রশিদ ধরিয়ে দেয়ার অনৈতিক চর্চা বন্ধ করতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ করা উচিত।
অতিরিক্ত ভর্তি ফি’র ব্যাপারে সেন্ট ইউফ্রেজীস গালর্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সিস্টার মেবেল কস্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সিদ্দিক নুর আলম বলেন, আমি ব্যাপারটা অবগত ছিলাম না। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এআই/
আরও পড়ুন