অনলাইন ক্লাস সিদ্ধান্তে দোদুল্যমান শিক্ষক-শিক্ষার্থী
প্রকাশিত : ২৩:৪৭, ২২ এপ্রিল ২০২০
করোনা ভাইরাস বিশ্বব্যাপী মহামারী আকার ধারণ করেছে। বিশ্বব্যাপী এ ভাইরাসে মৃত্যু ছাড়িয়েছে দেড় লক্ষ। সারাবিশ্বের সকল মানুষই যেন লড়াই করে চলছে কোভিড- ১৯ নামক অদেখা এক মরণ ঘাতকের সাথে। পরীক্ষা মূলক ভাবে বিভিন্ন ঔষধ প্রয়োগ করা হলেও এখনো পর্যন্ত এই রোগের নির্দিষ্ট কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। এ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো সতর্কতা অবলম্বন করা। সংক্রমিত রোগী থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা । তবে কেউই জানে না কে ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন। তাই সকলের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপনই এ যুদ্ধের একমাত্র অবলম্বন।
আর সেই অদেখা ঘাতককে হারাতেই বন্ধ করা হয়েছে বিশ্বের খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিল্প প্রতিষ্ঠান সহ সকল ধরণের অফিস আদালত। সকল ধরণের গণ জমায়েত এড়াতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল সহ সব এলাকাই লক ডাউন করা হয়েছে। বাংলাদেশ নিষ্ঠুর এ অদেখা ভাইরাসের সাথে লড়াইয়ের ৭ম সাপ্তাহ পার করছে। বিশ্বের অন্য সব দেশের মত এখানেও বন্ধ করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ সহ সকল ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। চালু নেই কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং কোন ধরনের অফিস আদালত।
তবে লক ডাউনের মধ্যেই সরকারি ভাবে টেলিভিশনের মাধ্যমে চলছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেনীর শিক্ষার্থীদের পাঠদান। অব্যহাতভাবে বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে পাঠদানের চেষ্টা করছে বেসরকারি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ। তবে অনলাইনে ক্লাসের সিদ্ধান্ত নিলেও নানা সমস্যার কারনে তা বাস্তবায়নে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। অনলাইনে ক্লাস সিদ্ধান্তে শিক্ষক-শিক্ষার্থী কারোই যেন সমীকরণ মিলছে না। বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য প্র. ড. মো. দিদার-উল-আলম অনলাইনের ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগের কথা জানালেও হওয়া না হওয়ার অফিসিয়াল ভাবে কোন নোটিশ দেয়া হয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ।
ক্লাস হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর ড. নেওয়াজ মোহাম্মদ বাহাদুর বলেন, ইজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী উপাচার্য মহোদয় সকল অনুষদের ডিনদেরকে নিয়ে অনলাইনে একটি মিটিং আহবান করেন। সকলের সম্মতিক্রমে মিটিংএ অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এবং ডিনরা সংশ্লিষ্ট বিভাগ সমূহকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। তবে এক্ষেত্রে কোন শিক্ষার্থী যেন ক্লাস সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়। শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে বাস্তবতার আলোকে ক্লাস নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়।
চলমান মহামারী পরবর্তীতে সরকারি বন্ধের দিনগুলোতেও ক্লাস নেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সেশন জট এড়ানোর ব্যক্তিগত মতামতের কথা জানান প্রক্টর। এছাড়াও অবসর সময়ে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে স্কিল ডেভেলপমেন্ট কোর্স করার দাবির কথা বললে বাস্তবতার আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারেও জানান প্রক্টর। সেখান থেকে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে কোর্স করতে পারবে।
ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামের কাছে অনলাইনে ক্লাসের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এই সেমিস্টারে আমার পাঁচটি কোর্স রয়েছে। কিছু কমিয়ে না রাখলে পরবর্তীতে সম্পন্ন করা কষ্টসাধ্য হবে। সেজন্য আমি অনলাইনে ক্লাস নেয়া শুরু করেছি। তবে ইন্টারনেট সমস্যা থাকায় কিছু শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে নাই। আমি শিক্ষার্থীদের ক্লাস মেটেরিয়ালস দিয়ে দিচ্ছি। এতে যাদের বুঝতে সমস্যা হবে তারা যেকোন মাধ্যমে যোগাযোগ করলে আমি বুঝিয়ে দিব। এবং যে লেকচার বুঝতে বেশি সমস্যা হবে সেটা পরবর্তীতে ক্যাম্পাস খোলার পর আবার নেওয়া হবে।
এদিকে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানালেও শিক্ষার্থীদের বিরূপ মতামতের ফলে থেমে আছেন কয়েকজন শিক্ষক। সংশ্লিষ্ট বিভাগের ক্লাস প্রতিনিধির মাধ্যমে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে ২/১ টি ক্লাস
নিয়েও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার দরুন ক্লাস বাদ দিয়ে মহামারী প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের সাহচার্য দিয়ে যাচ্ছেন কোন কোন শিক্ষক। করোনায় আক্রান্ত এলাকার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বন্ধু ও অনুন্নত ইন্টারনেট পরিসেবা মূলক এলাকায় থাকা সহপাঠীদের কথা ভেবে অনলাইনে ক্লাস না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রথমে ক্লাস করার ইচ্ছা পোষণ করা শিক্ষার্থীরাও। একই কারণে প্রিয় শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে অনলাইনে ক্লাস না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কয়েকজন শিক্ষকও।
পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকলেও বৈশ্বিক মহামারীর কারণে সেশন জটকে তুচ্ছ জ্ঞান করছেন সকলেই। কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড টেলিকমিউনিকেশন ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ও নোবিপ্রবি ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, করোনা মুক্তির ব্যাপারে সকলে অনিশ্চিত। তাই অনলাইনকে পুঁজি করে সিলেবাস কিছু এগিয়ে রাখতে পারলে ক্যাম্পাস খোলার পর বিভাগ সমূহকে পরীক্ষার জন্য আর বাড়তি দিন গুনতে হবে না। তবে এক্ষেত্রে সব শিক্ষার্থীর অংশ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
গ্রামাঞ্চলে থাকায় ওয়াইফাই সেবা নেই এবং ইন্টারনেট সেবা দূর্বল। এছাড়াও সকলের পক্ষে এই মুহূর্তে প্রয়োজনানুসারে ডাটা কেনা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টারনেটের বিশেষ প্যাকেজ সুবিধা দিয়ে ডাটার সমস্যা গুছানো সম্ভব। এবং নির্দিষ্ট এপস এর সাথে (জুম, স্কাইপি ইত্যাদি অনলাইন ভিডিও সেবা) চুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি ইন্টারনেট সেবা চালু করা যেতে পারে।
তিনি আরো বলেন, করোনা আতঙ্কে থাকায় অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা চালিয়ে নেয়ার মানসিকতা নেই। বিশেষ করে হটস্পট অঞ্চলগুলোর শিক্ষার্থীরা রীতিমতো ট্রমার মধ্যে আছে। যার কোন সমাধান নেই। সুতরাং সকলের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করে শিক্ষা চালিয়ে নেওয়াটা দুষ্কর। যদিও এটাও সত্যি যে করোনা পরবর্তী পৃথিবী হয়তো অনেক কঠিন হবে। এবং সেখানে যোগ্যতমরাই টিকে থাকবে।
এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক স্কিল ডেভেলপমেন্ট করা হয় এমন বিশেষায়িত অনলাইন শিক্ষামূলক সাইটগুলোর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এবং সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করে কিছু অ্যাডভান্স স্কিল ডেভেলপ করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এতে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে উপকৃত হবে পারবে।
কৃষি বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ এন্ড লিবারেশন ওয়্যার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল মাওয়া এ ব্যাপারে তাদের মতামত জানান। তাদের মতে, অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার মাধ্যমে শেসন জট কিছুটা এড়ানো সম্ভব হবে। করোনা পরবর্তীতে কিছু দিন ক্লাস নিয়েই পরীক্ষা নেওয়া যাবে। তবে গ্রামে ওয়াই-ফাই সুবিধা না থাকায় এবং নেট দূর্বলের কারণে অনেক শিক্ষার্থীই এতে বঞ্চিত হবে। এবং স্বল্প দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে যাওয়ায় সকলের কাছে প্রয়োজনীয় শিক্ষা সরঞ্জামও নেই। কাজেই ক্লাসে অংশ নেওয়া এবং স্যারদের দেয়া কাজগুলো সকলে সম্পন্ন করতে পারবে না। সুতরাং সকলের সুবিধা নিশ্চিত করে অনলাইন ক্লাস নেওয়া সম্ভব নয়।
আরকে//
আরও পড়ুন