ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪

পাশের বাড়ির সেই মেয়েটি

সোহাগ আশরাফ

প্রকাশিত : ১১:০৮, ২০ এপ্রিল ২০২১ | আপডেট: ১১:৩৮, ২০ এপ্রিল ২০২১

সত্তর ও আশির দশকের কথা। সেই সময় দেশের গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শহুরে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত, সবার কাছেই তিনি ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। ঢাকাই সিনেমার জগতে অন্য কোনো অভিনেত্রীর ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেনি।

অন্যদের চেয়ে কবরীর এ আলাদা অবস্থানের কারণ অভিনয় শিল্পী হিসেবে তার নিজস্ব স্বকীয়তা ও সহজাত প্রবৃত্তি। সিনেমার পর্দায় বাংলাদেশি সাধারণ মেয়ে হিসেবে তাকে যেভাবে দেখা যেত, বাস্তবের গ্রামীণ নারী বা শহুরে মধ্যবিত্তের ঘরের মেয়ের চরিত্রটাও ঠিক সেরকমই ছিল। তাইতো তাকে বলা হয় ঢাকাই সিনেমার ‘মিষ্টি মেয়ে’। এ উপাধি দর্শকরাই তাকে দিয়েছিলেন। কৈশোর আর যৌবনের পাট চুকিয়ে ‘মিষ্টি মেয়ে‘ কবরী সেই গ্রহণযোগ্যতা ধরে রেখেছিলেন সবসময়ই। ‘মিষ্টি মেয়ে’ ছাড়া তিনি ‘পাশের বাড়ির মেয়ে’ হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। কারণ তার চেহারা, আচরণ এবং অভিনয়ে সেই বিষয়টা ছিল।

কিংবদন্তি এই অভিনেত্রী খুব বেশি মেক আপ করতেন না, এমনকি চুলটাও রাখতেন একদম সাধারণ একটা মেয়ের মত। যার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে খুব আপন হয়ে ধরা দিতেন কবরী।

১৯৬৪ সাল। সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ সিনেমার মাধ্যমে অভিনয় জীবন শুরু করেন ‘মিষ্টি মেয়ে’ কবরী। তারপর একের পর এক সফল সিনেমা দিয়ে দর্শকদের মনে স্থায়ী আসন গেড়ে নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সে বছরের ১৯ এপ্রিল পরিবারের সদস্যদের সাথে ঢাকা থেকে প্রথমে গ্রামের বড়ি এবং পরে সেখান থেকে ভারতে পাড়ি জমান অভিনেত্রী। কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও চলচ্চিত্র জগতে মনোনিবেশ করেন। কাজ করেছেন শতাধিক চলচ্চিত্রে। এমনকি নির্মাণও করেছেন তিনি। যুক্ত হয়েছেন রাজনীতিতেও। হয়েছেন সংসদ সদস্য। এই করোনাকালেও তিনি যুক্ত ছিলেন তার পরিচালিত নতুন সিনেমা ‘এই তুমি সেই তুমি’ নিয়ে। মৃত্যুর আগে শেষ করেছেন এর শুটিং। সাবিনা ইয়াসমিনকে দিয়ে তৈরি করিয়েছিলেন গানও। কিন্তু সেই সিনেমা অসম্পূর্ণ রেখেই চিরবিদায় নিলেন কবরী। আর এর সাথে অসম্পূর্ণ থেকে গেল কিংবদন্তী অভিনেত্রীর অনেক স্বপ্নও।

কবরী ১৯৭৩ সালে ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, নায়ক রাজ্জাকের সঙ্গে ‘রংবাজ’ সিনেমা দিয়ে দর্শকদের হৃদয়ে স্থান করে নেন।

এরপর ১৯৭৫ সালে নায়ক ফারুকের সঙ্গে ‘সুজন সখী’ ছাড়িয়ে যায় আগের সব জনপ্রিয়তাকে। তারপর কেবলই এগিয়ে চলা। কবরীর জনপ্রিয় সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘আগন্তুক’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘ময়নামতি’, ‘সারেং বৌ’, ‘দেবদাস’, ‘হীরামন’, ‘চোরাবালি’, ‘পারুলের সংসার’।

৫০ বছরের বেশি সময় চলচ্চিত্রে রাজ্জাক, ফারুক, সোহেল রানা, উজ্জ্বল, জাফর ইকবাল ও বুলবুল আহমেদের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। সবার সঙ্গেই তিনি সফল এবং জনপ্রিয় জুটি ছিলেন। তবে ঢাকার চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় জুটি ছিলেন রাজ্জাক-কবরী। ঢালিউডের সিনেমায় নায়ক রাজ হিসেবে পরিচিত রাজ্জাকের সাথে তার জুটি এখন পর্যন্ত নিঃসন্দেহে দেশের চলচ্চিত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আলোচিত জুটি। বাংলাদেশের সিনেমায় কিংবদন্তী তুল্য এই জুটি দর্শকদের কাছে যতটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল, তার ধারে কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি আর কোনো জুটি।

উল্লেখ্য, কবরীর জন্ম ১৯৫০ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামে। তার আসল নাম ছিল মিনা পাল। এই মিনা পাল থেকে তার নায়িকা কবরী হয়ে ওঠার গল্পটা বেশ চমকপ্রদ। তখন তিনি চট্টগ্রাম নগরীর ফিরিঙ্গি বাজারের জেএম সেন স্কুলে পড়তেন। ১৯৬৪ সালে সপ্তম শ্রেণিতে উঠেই সুযোগ পান সিনেমায় অভিনয়ের। সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ সিনেমাতে মিনা পাল নাম বদলে তিনি হয়ে গেলেন কবরী।

কবরী অর্থ খোঁপা। সেই সিনেমাতে ভূবনমোহিনী হাসি দিয়ে তার নাম হয়ে গেল ‘মিষ্টি মেয়ে’। সিনেমাটির অন্যতম প্রযোজক ছিলেন চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী চিত্ত চৌধুরী। সেই চিত্ত চৌধুরীর সঙ্গেই প্রথম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন কবরী। সেই সম্পর্কে বিচ্ছেদের পর ১৯৭৮ সালে তিনি বিয়ে করেন সফিউদ্দীন সরোয়ারকে। ৩০ বছর পর ২০০৮ সালে সেই সম্পর্কেরও বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর যখন রাজনীতিতে আসেন এবং সংসদ সদস্য হন, তখন থেকে তিনি সারাহ বেগম কবরী নামে পরিচিত।

কবরী ২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সিনেমায় অভিনয় ছাড়াও সিনেমা প্রযোজনা এবং পরিচালনার সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। একাধিকবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার।

গত ১৬ এপ্রিল (শুক্রবার) দিবাগত রাত ১২টার পর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন কবরী।

এসএ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি