‘দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে’
প্রকাশিত : ১৩:৫৬, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে/
তোমার ও পথ আলোয় ভরানো জানি,
আমার এ পথ আঁধারে আছে যে ঢেকে …
সত্যিই তাই। আজ ২২ ফেব্রুয়ারি। কার্যকর হচ্ছে আইনি বিচ্ছেদ। শাকিব খান-অপু বিশ্বাসের পথ এখন দুটি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের মতই আজ দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে। লুকুচুরি প্রেম, গোপনিয় সংসার, মান-অভিমান, সন্তান সব কিছুর ইতি ঘটছে বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে। যদিও দুজনের মনের বিচ্ছেদ হয়েছে অনেক আগেই, তবে আজ কাগজে কলমে সব কিছুর ইতি টানছেন দুজন।
২০০৬ সালের কথা। শাকিব খান তখন শুধুই বাংলাদেশের সিনেমার একজন অতিসাধারণ হিরো। আজকের মতো তারকাখ্যাতি ছিলো না তার। অভিনেতা ও প্রযোজক মনোয়ার হোসেন ডিপজল বড় বাজেটের একটি সিনেমা নির্মাণ করবেন। সিনেমার নাম ‘কোটি টাকার কাবিন’। যেখানে সিনেমার নায়ক হিসেবে তিনি পছন্দ করলেন শাকিব খানকে। তার বিপরীতে ডিপজল চাইলেন নতুন কোন নায়িকা। যেমন চাওয়া, তেমন পাওয়া। ডাক পড়ল অপু বিশ্বাসের। যতটুকু মনে পড়ে আমজাদ হোসেনের ‘কাল সকালে’ ও সুভাষ দত্তের ‘ও আমার ছেলে’তে অভিনয় করেছিলেন অপু। তবে সেটা বড় কোন চরিত্র নয়। বগুড়াতেই থাকতেন তিনি। অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার ইচ্ছে তখনও জাগেনি অপুর। এরই মধ্যে মাধ্যমিকে পরীক্ষা দিলেন অপু। পরীক্ষা শেষে কিছুটা বিরতি। ঠিক সেই সময় সুযোগ আসে ‘কোটি টাকার কাবিন’ সিনেমার।
কোন চিন্তা না করেই অপু রাজি হয়ে যান। কারণ স্বপ্নের নায়ক শাকিব খানকে পাচ্ছেন নিজের নায়ক হিসেবে। শাকিব তখন ঢালিউডের পরিচিত মুখ। তবে সুপারস্টার নয়। তার বেশ কিছু সিনেমা দেখেছেন অপু। এবার সামনা সামনি দেখার সুযোগ মিলে গেলো। এই সিনেমার সূত্র ধরেই শুটিং সেটে প্রথম দৃষ্টি বিনিময়। শাকিবকে ‘ভাইয়া’ বলে ডাকতেন অপু। ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন তাকে।
‘কোটি টাকার কাবিন’ সিনেমার শুটিং শুরু করলেও খুব একটা জানাশোনা হয়নি দুজনার। তাই সেটে বসে একে অপরকে লুকিয়ে দেখেন দুজন। কিন্তু ওইভাবে কোনো কথা হয় না। এভাবেই অল্প অল্প পরিচয়ে কিছুটা কাছে আসা। শাকিব অপুর কাছ থেকে ফোন নম্বর নেন। যদিও তখন শাকিব অনেকটা নার্ভাস ছিলো। এরপর অপুকেই প্রথম ফোন করেন শাকিব। তবে তার আগে এসএমএস দিয়ে জানান- ‘আমি রানা (শাকিবের ডাক নাম), ফোন রিসিভ করো। অপু লজ্জা পেলেন। সবার সামনে ফোন রিসিভ না করে ওয়াশরুমে ঢুকে পানির কল ছেড়ে দিয়ে শাকিবের সঙ্গে প্রথম কথা বললেন অপু। এভাবে দেড় মাস ফোনো প্রেম। কোন কোন দিন ফোনে শাকিবের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মায়ের কাছে ধরাও পড়েছেন অপু। শাস্তিস্বরূপ অপুকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতে, বোনের বাসায়। সেখানেই থাকতে হবে, সিনেমায় আর অভিনয় করা যাবে না। কিন্তু প্রেম যে মানে না কোন বাধা। ভারতে যাওয়ার পর অপুর প্রেম আরও গভীর হয়। রাস্তার পাশের ফোন বুথ থেকে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে শাকিবকে ফোন করতেন অপু। প্রেমিকার ফোন পেয়ে সিনেমার শিডিউল ফাঁসিয়ে শাকিব চলে যান ভারত। তাও বিমানে নয়, বাসে চড়ে। ঢাকা থেকে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন শাকিব। দেখা করলেন প্রেমিকার সঙ্গে। ঘুরতে গেলেন দার্জিলিং। যদিও দেশে ফিরে শিডিউল ফাঁসানোর দায়ে বিপদে পড়তে হয়েছিল শাকিবকে।
এদিকে ‘কোটি টাকার কাবিন’ মুক্তি পেয়েছে। মুক্তির পরেই সুপারহিট। নতুন এ জুটির সাফল্য দেখে ডিপজল আরও চারটি সিনেমার ঘোষণা দেন। সিনেমা করলেই শাকিবের কাছাকাছি থাকতে পারবেন অপু। তাই রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু বাধা শুধু পরিবার। কে শোনে কার কথা! বিদ্রোহ করলেন অপু। দেশে ফিরে এসে বগুড়ার এক কলেজে ভর্তি হলেন তিনি। শাকিব তখন শুটিং ফেলে কলেজের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। অপুর মা শাকিবের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করতেন না। একদিন শাকিবের মুখোমুখি হলেন তিনি।
শাকিব বললেন, ‘আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করব।’
অপুর মা বললেন, ‘আর সেদিনই আমি মেয়েকে ত্যাজ্য করব।’
ভালোবাসার বন্ধন আরও মজবুত করতে শাকিব বিয়ের ডেট ফিক্সড করেন। সেদিন ছিলো ১৮ এপ্রিল ২০০৮। এ দিনে বিয়ে করার কারণ, সেদিন শাকিবের বাবা-মা বাসায় থাকবেন না। শাকিবের ফুপাতো ভাই তানভীরের মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাবেন। নির্ধারিত সময়ে কাজি ডেকে আনা হলো। ভালোবাসার টানে ধর্ম ত্যাগ করে অপু বিশ্বাস হয়ে গেলেন অপু ইসলাম খান। সেদিনের বিয়েতে ছিলেন অপুর মেজ বোন, শাকিবের কাজিন মুনির ও প্রযোজক মামুনুজ্জামান মামুন। বিয়ের পর অপু চলে গেলেন তাঁর বাসায়। বিয়ের বিষয়টা শাকিবের বাবা-মা, অপুর মা জানতেন না। ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ছাড়া চলচ্চিত্রেরও তেমন কেউ জানতেন না। বছরখানেক পর দুজন একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন।
অপু বক্তব্য, ‘যেন কেউ সন্দেহ করতে না পারে, সে জন্য শুটিংয়ের সময় শাকিবের ধারেকাছেও থাকতাম না। শটের সময় চলে যেতাম ক্যামেরার সামনে। অনেকের সন্দেহ হয়েছে; কিন্তু নিশ্চিত হতে পারেননি। শুটিংয়ে শাকিবের সঙ্গে কথা না বললেও বাসায় ফিরে ঠিকই শাকিবের জন্য রান্নায় বসে যেতাম।’
এরই মধ্যে দুজন ঢালিউডের সেরা জুটিতে পরিণত হলেন। তাদের সিনেমা মুক্তি পাওয়া মানেই হিট। সংসার শুরুর পর থেকেই তাঁদের মান-অভিমান চরমে ওঠে। শাকিব ঘোষণা দিলেন, তিনি আর অপুর সঙ্গে সিনেমা করবেন না। অভিমানের কারণ, অন্য এক নায়কের সঙ্গে কথা বলেছেন অপু। এরই মধ্যে তিনবার অন্তঃসত্ত্বা হন অপু, তিনবারই গর্ভপাত করান শাকিব। চতুর্থবার ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালের চিকিৎসক বললেন, এবার গর্ভপাত করালে আর কখনো মা হতে পারবেন না। ঠিক তখনই সন্তান জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন অপু। কিন্তু শাকিব সন্তান চাইছেন না। শাকিবের ধারণা হয়েছে, অপু তাঁকে ব্ল্যাকমেইল করছে। যেখানে তিনি বিয়ের খবরই কাউকে জানাননি, সন্তান হলে তিনি মুখ দেখাবেন কিভাবে। ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে। নিশ্চয়ই শত্রুরা অপুকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন। এক পর্যায়ে শাকিবের বাড়ি থেকে চলে আসেন অপু। এগুলো সব চলতে থাকে গোপনে। গণমাধ্যম তখনও টের পায়নি এই খবর। তবে ভাসা ভাসা কিছু খবর বাতাসে উড়তে থাকে। সবার ধারণা অপু-শাকিবের মধ্যে কিছু একটা সম্পর্ক ঠিকই রয়েছে। কিন্তু সেই সম্পর্ক যে এতো দূরে গড়িয়েছে তা কোন ভাবেই আচ করতে পারেনি গণমাধ্যম।
২০১৬ সালের মাঝামাঝি হঠাৎ হারিয়ে যান ঢাকাই সিনেমার এই নায়িকা। এর মধ্যে অবশ্য শোনা যায়- শাকিব খানকে বিয়ে করেছেন অপু। তবে সেটা গুঞ্জন। দুই তারকার কেউ ই সেই খবর নিশ্চিত করেননি। এমনও শোনা যায় যে-অপুর পেটে সন্তান এসেছে। কিন্তু তাও গুঞ্জন। অবশেষে ১০ মাস পর ১০ এপ্রিল ২০১৭-তে গণমাধ্যমের সামনে হাজির হন অপু বিশ্বাস। কোলে তার শিশুপুত্র আবরাম খান জয়। টিভি লাইভে কান্নায় ভেঙে পড়েন অপু। জানান ৯ বছরের সংসার ও সন্তানের কথা। তবে এবার সব গোপনিয়তা ভেঙে লাইভে আসার নেপথ্যে ছিলেন অন্য আরেক নায়িকা। নাম তার শবনম বুবলি। তাঁর সঙ্গে শাকিবের ঘনিষ্ঠতা মানতে পারেননি অপু। সে জন্যই বোমা ফাটান তিনি। যদিও শুরুতে শাকিব খান সব অস্বীকার করেন। কিন্তু সত্য যে মানতেই হবে। তাই নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভেবে বুদ্ধি খাটিয়ে গণমাধ্যমের সামনে আসেন শাকিব। সন্তানকে কোলে নিয়ে সব বিতর্ক মুছে দেন এই নায়ক। কিন্তু মনের মধ্যে রয়ে যায় চাপা ক্ষোভ। সেই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে জয়ের জন্মদিনে। এরপর যা ঘটেছে তা সবারই জানা।
২২ নভেম্বর অপুর ঢাকার বাসা ও বগুড়ার বাসায় তালাকনামা পাঠান শাকিব খান। তারপরও অপু অনেক স্থির ছিলেন। চেয়েছিলেন হয়তো শাকিব সব ভুলে গিয়ে আবারও সন্তানের টানে অপুর কাছে ফিরবেন। কিন্তু না কোন ভাবেই শাকিবকে বসে আনতে পারলেন না অপু। আজ ২২ ফেব্রুয়ারি। আজ থেকে কার্যকর হলো তাঁদের বিচ্ছেদ।
তবে এখনও রয়েগেছে কিছু বিষয়। বিচ্ছেদ হলেও দেনমোহর বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত আসে তার অপেক্ষায় ভক্তরা। একই সঙ্গে সন্তান জয় কোথায় থাকবেন? তাকে শাকিব বাবা হিসেবে কতটুকু সময় দিবেন? তার বিষয়ে দুই তারকার সিদ্ধান্ত কি হবে? এসব নিয়ে চলছে গুঞ্জন। দেখা যাক কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে আটকায়!
এসএ/