‘একদিন কান্নার রোল উঠবে আমার বাড়িতে’
প্রকাশিত : ০০:০৩, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৪:০৯, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
একদিন কান্নার রোল উঠবে আমার বাড়িতে, আমায় নতুন করে দেখতে সবাই আসবে সারি সারিতে, বন্ধু বান্ধব আসবে যারা কতো প্রশ্ন করবে তারা, আমি থাকবো শুয়ে বালিশ ছাড়া, পারবো না ঠোঁট নাড়িতে- নকুল কুমার বিশ্বাসের লেখা এই গানটি গেয়েছিলেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ।
মৃত্যুকে মনে করিয়ে দেয়া এই হৃদয়গ্রাহী গানটির সুরকার ছিলেন আলী আকবর রুপু। গানের মতোই আজ তার বাড়ীতে চলছে কান্নার রোল। ভক্তদের চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রু। সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া পড়ে পুরো মিডিয়া জগতে।
রুপুর মামা সুরকার ও সংগীত পরিচালক আলাউদ্দীন আলী বলেন, ‘১৯৫৮ সালের রুপুর মা আমার মেজ বোন জামিলা মনসুরের বিয়ের পরে রুপুর জন্ম হয়। আমাদের কোলে পিঠে বড় হলো সে। এর মধ্যে কতটুকু সময় গেল? এই অল্প সময়ে সে চলে গেল। আল্লাহ রুপুকে তার মায়ের সাথে বেহেস্তে স্থান দিও।’
দীর্ঘ দিন এক সঙ্গে কাজ করেছেন জনপ্রিয় উপস্থাপক হানিফ সংকেত ও আলী আকবর রুপু। হানিফ সংকেত তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আলী আকবর রুপুর এই অকাল মৃত্যুতে আমাদের সংগীতাঙ্গনের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেলো। আমরা তার বিদেহি আত্মার শান্তি কামনা করছি।’
আলী আকবর রুপুর প্রতি সবার ছিল অন্য রকম ভালোবাসা। তিনি মানুষকে খুব সহজে আপন করে নিতে পারতেন। এই মহান মানুষটির শুরুটা হয়েছিল একজন গিটারিস্ট ও কিবোর্ড বাদক হিসেবে। তারপর ১৯৮০ সালে ‘একটি দুর্ঘটনা’ অ্যালবাম দিয়ে অডিও গানে তার অভিষেক ঘটে। প্রথম অ্যালবামেই তিনি বাজিমাত করেন। গানগুলো বেশ প্রশংসিত হয়।
তারপর ১৯৮২ সালের দিকে ‘উচ্চারণ’ ব্যান্ডে কিছুদিন গিটার ও কি-বোর্ড বাজিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে উচ্চারণ ছেড়ে দেন। এরপর ‘উইন্ডস’ নামে একটি ব্যান্ড গঠন করেছিলেন।
১৯৮৪ সালে মালেক আফসারী পরিচালিত ‘রাস্তার ছেলে’ ছবিতে গান করে জনপ্রিয়তা পান এ সুরকার। মাত্র ছয়টি চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন তিনি। আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘দুই বেয়াইর কীর্তি’ তার সংগীত পরিচালনায় সর্বশেষ চলচ্চিত্র।
তবে আলী আকবর রুপু দেশের সর্বত্র পরিচিতি পেয়েছিলেন বিটিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র হাত ধরে। ‘ইত্যাদি’তে আলী আকবর রুপু প্রায় ২৫ বছর ধরে বিভিন্ন গানের সুর ও কম্পোজ করেছেন। হানিফ সংকেতের মুখে অনুষ্ঠানটির প্রতি পর্বে আলী আকবর রুপুর নাম শোনাটা হয়ে উঠেছিলো নিয়মিত বিষয়।
আলী আকবর রুপুর সুর ও সংগীত পরিচালনায় অসংখ্য গান জনপ্রিয় হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কুমার বিশ্বজিতের গাওয়া ‘একদিন কান্নার রোল উঠবে আমার বাড়িতে’, ‘যারে ঘর দিলা সংসার দিলা রে’, ‘দস্যু যেমন মুখোশ পরে প্রবেশ করে ঘরে’, ‘দরদিয়া’, ‘এ অনিশ্চয়তা’, ‘এ পশলা বৃষ্টি’।
সাবিনা ইয়াসমিনের ‘প্রতিটি শিশুর মুখে হাসি’, এন্ড্রু কিশোরের ‘পদ্ম পাতার পানি নয়’, মুরাদের ‘আমি আগের ঠিকানায় আছি’, শাকিলা শর্মার ‘তোমাকে দেখলেই মৌনতা ভুলে যাই’, সাবিনা ইয়াসমিন, কনক চাঁপা ও সামিনা চৌধুরীর ‘সব চাওয়া কাছে পাওয়া’, নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর ‘কবিতার মতো মেয়েটি, গল্পের মতো ছেলেটি’, সামিনা চৌধুরীর ‘জানতে চেয়ো না কোন সে বেদনাতে’, দিনাত জাহান মুন্নীর ‘পুরোনো কাপড়ের মতো আমি আজ অবহেলিত’, মৌটুসীর ‘বারে বারে পোড়া বাঁশি এত রাতে আর ডেকো না’ ইত্যাদি।
এছাড়াও তিনি তিনটি টিভি চ্যানেলের উদ্বোধনী সংগীত তৈরি করেছেন। গানগুলো হলো একুশে টিভির ‘নব শতকের সম্ভাবনার দিনে’, এনটিভির ‘বাংলাদেশের বিজয়ের আলো জ্বেলে’ আর এটিএন বাংলার ‘দিনরাত এটিএন এশিয়া ইউরোপে’।
সর্বশেষ বেসরকারি টেলিভিশন বাংলাভিশনে কর্মরত ছিলেন আলী আকবর রুপু।
ব্যক্তিজীবনে আলী আকবর রুপু ছিলেন সুখী একজন মানুষ। স্ত্রী নারগিস আকবর, পুত্র সিডনি ও একমাত্র মেয়ে ফারিয়া নাজকে নিয়ে ছিলো তার সুখের সংসার। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বাস করছিলেন মগবাজারের ডাক্তারের গলিতে।
অনেকদিন ধরেই ডায়াবেটিস, হার্ট ও কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন আলী আকবর রুপু। হঠাৎ তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে গত ২২ ফেব্রুয়ারি তাকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন থেকে বেলা ১২টা ৪০ মিনিটে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে।
এসি/