‘বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে আজ আমি অসহায়’
প্রকাশিত : ১৮:৫৬, ৩০ এপ্রিল ২০১৮ | আপডেট: ২২:২৮, ৩০ এপ্রিল ২০১৮
বেঁচে থাকার লড়াইয়ে হার না মানা একটি নাম সাদেকুর রহমান হিরু। তার জীবনের গল্পটা একটু অন্যরকম। প্রায় দশ বছর ধরে তিনি কাজ করছেন বাংলা সিনেমায়। চলচ্চিত্রকে ভালোবেসে এখনো পড়ে আছেন এই জগতে। কিন্তু কাজ না পাওয়ায় অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটে তার। সিনেমার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগে বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে চলন্ত ট্রেনের নিচে পড়ে সারাজীবনের জন্য পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরন করেন হিরু। তারপর বদলে যায় তার জীবন। শুরু হয় বেঁচে থাকার অন্যরকম লড়াই।
হিরু মিয়ার গ্রামের বাড়ী ময়মনসিংয়ের তারাকান্দি। এখন থাকেন ঢাকার মগবাজারের গাবতলা এলাকায়। একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জনক হিরু মিয়ার যত দুশ্চিন্তা তার মেয়েকে নিয়ে। কাজ নেই তাই মেয়ের স্কুলের খরচ চালানোর ক্ষমতাও তার নেই। খেয়ে না খেয়ে পার হচ্ছে তার জীবন। মানুষের কাছে হাত পেতে টাকা নিতে তার খুব লজ্জা হয়। কিন্তু সে নিরুপায়। যে বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে আজ হিরুর এ অবস্থা সে কোনো দিন তার খোঁজও নেয়নি।
সাদেকুর রহমান হিরু তার জীবনের না বলা কথাগুলো বলেছেন একুশে টিভি অনলাইনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আউয়াল চৌধুরী।
একুশে টিভি অনলাইন: কিভাবে আপনি পা হারিয়েছেন?
সাদেকুর রহমান হিরু: ২০০৩ সালের দিকের ঘটনা। আমার এক বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে ট্রেনের নিচে পড়ে যাই। তখন এ পা-টা হারাই। আমরা আমাদের এলাকা বিশকা থেকে কয়েকজন বন্ধুসহ ময়মনসিংহ যাচ্ছিলাম। সবাই ট্রেনে উঠে যায় কিন্তু এক বন্ধু উঠতে পারেনি। তখন ট্রেন ছেড়ে দেয়। আবার অন্য পাশ থেকে ঐ সময় আরেকটি ট্রেন চলে আসে। ফলে সে ট্রেনের ফাঁকে পড়ে গেলে আমাকে বাঁচাতে বলে। আমি তাকে বাঁচানোর জন্য টেনে তুলতে গেলে নিজেই ট্রেনের নিচে পড়ে যাই।
একুশে টিভি অনলাইন: আপনাকে কে হাসপাতালে নিয়ে গেল?
সাদেকুর রহমান হিরু: এ প্রশ্ন শুনে হিরো মিয়ার চোখে পানি চলে আসে। চোখ মুছে হিরু বলেন, আমি ট্রেনের নিচে পড়ে রক্তাত্ত অবস্থায় পড়ে আছি। কত মানুষ আমাকে দেখতে আসলো কিন্তু কেউ হাসপাতালে নিলো না। সবাই দেখে দেখে চলে যায়। অনেককে বললাম ভাই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। আমি বাঁচবো। তখন লোকজন বলে তুমি আর বেশিক্ষণ টিকবে না। দুনিয়াটা আরেকবার ভালো করে দেখে নাও। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো আমি পড়ে আছি সেখানে।
ঐ সময় এক মহিলা তার হাজব্যান্ডসহ সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে তাদের মায়া হলো। তখন ঐ মহিলা তার স্বামীকে বললো ওকে হাসপাতালে নিয়ে চল। যেহেতু অনেক্ষণ হয়ে গেছে মারা যায়নি, বাঁচতেও পারে। পরে ঐ মহিলার উৎসাহে সবাই আমাকে সহযোগিতা করা শুরু করলো। তারপর হসপিটালে নেওয়ার জন্য সিএনজি খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কেউই নিতে চায়না। সবাই পাশ কেটে চলে যায়। ঐ সময় সেখান দিয়ে বিদেশীদের একটি গাড়ী যাচ্ছিলো। মহিলা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গাড়ীটি থামায়। তাদেরকে সব কিছু বলার পর তারা আমাকে দ্রুত হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ভর্তি করিয়ে দেয়। তারা ছিল কোরিয়ান। আমাকে তারা নতুন জীবন দিয়ে গেল।
একুশে টিভি অনলাইন: তারা কিভাবে নতুন জীবন দিয়ে গেল? তারা কি কোনো সহযোগিতা করেছিল?
সাদেকুর রহমান হিরু: বিদেশীরা আমার জীবন বাঁচিয়েছে। আর ঐ মহিলাটি; তিনি চেষ্টা না করলে বাঁচতে পারতাম না। বিদেশীরা আমার ঔষুধ খরচ, ডাক্তারের বিল সব দিয়েছে। তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তাদের উসিলায় হয়ত আমি এখনো বেঁচে আছি। তবে তাদের সঙ্গে আর কোনো দিন আমার দেখা হয়নি। এছাড়া আমার পরিবার আমাকে সহযোগিতা করেছে। আমার মা বোন আমার সেবা যত্ন করেছে।
একুশে টিভি অনলাইন: যে বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে আপনার এ অবস্থা তার সঙ্গে দেখা হয়?
সাদেকুর রহমান হিরু: আমার এক্সিডেন্ট হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো দিন সে খবর নেয় নাই। এই ১৫ বছরে কোনো দিন দেখতেও আসেনি। তার জন্যই আজকে আমার এ অবস্থা। এ জন্য আমার কোনো কষ্ট নেই। আমার ভাগ্য যা ছিল তাই হয়েছে। পা হারানোর পর থেকে আমার কষ্টের শুরু। কত খারাপভাবে যে দিন কেটেছে তা বলে শেষ করতে পারবো না।
একুশে টিভি অনলাইন: এখন কি কাজ করেন? কিভাবে পরিবার চলে?
সাদেকুর রহমান হিরু: আমি প্রায় ১০ বছর ধরে চলচ্চিত্রের সঙ্গে আছি। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করি। আমি যখন প্রথম এফডিসিতে আসি তখন বিভিন্ন লোকজন কাজের কথা বলে আমার কাছ থেকে পাও খেতো কিন্তু কাজ দিতো না। পরে সিনেমার এক বড় ভাই তিনি আমাকে বলেন, তোমাকে এরা কাজ দিতে পারবে না। তোমাকে কাজ দিতে পারবে ডিরেক্টর, প্রডিউসার ও ম্যানেজার। তুমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ কর। এখানে এদের পেছনে টাকা নষ্ট করো না। এরপর আমাকে ফাইট ডিরেক্টর চুন্নু মামা শিল্পী সমিতির কার্ড করে দেন। আগে ডিরেক্টররা আমাকে কিছু কিছু কাজ দিতো। আয় হতো। কিন্তু এখন কেউ কাজ দেয় না। বলা যায় খুব কষ্টে আছি। সংসার চলে না। অভাবে, না খেয়ে দিন কাটে। পরিবার চালানোর মতো অবস্থা আমার নেই।
একুশে টিভি অনলাইন: আপনি এখন কি করতে চান?
সাদেকুর রহমান হিরু: কেউ যদি কাজ না দেয় তাহলে কিভাবে আমার পরিবার চলবে। আমার মেয়েটার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষের সহযোগিতা নিয়ে কতদিন চলা যায়। হাত পাততে ভালো লাগে না। নিজের কাছে খারাপ লাগে। আমার স্বপ্ন মেয়েটা পড়া লেখা করে অনেক বড় হবে। জানিনা সে স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা। নিজের আর্থিক অক্ষমতা খুব কষ্ট দেয়। আমার ভাগ্য কেন এমন হলো জানিনা। জীবন যুদ্ধের লাড়াইয়ে হারতে চাইনা। কাজ করে বাঁচতে চাই। কেউ যদি আমাকে একটা দোকান করার ব্যবস্থা করে দিত তাহলে আমি সেটাই করতাম। আমাদের জীবনটা বাঁচাতাম। এই কষ্টের হাত থেকে পরিত্রান পেতাম। সবার মত হাসি আনন্দ নিয়ে বাঁচতে পারতাম।
কত মানুষের কাছে যাই সহযোগিতার জন্য কিন্তু কেউ তেমন পাত্তা দেয় না। আমিতো শুধু একটা কাজ চাই। বাঁচতে চাই পরিবার নিয়ে। আমার মেয়েটা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তাকে পড়ালেখা করাতে চাই। কিন্তু আমার সে সামর্থ্য নেই। এটা আমার জন্য খুব কষ্টের। তবু চেষ্টা করছি বেঁচে থাকার। লড়াই করে যাচ্ছি জীবনের সঙ্গে। চলচ্চিত্রের এত মানুষ তারা চাইলে আমার জন্য কিছু করতে পারে। তারা চাইলে আমাকে কাজ দিতে পারে। কিন্তু কেউ আমাকে নিয়ে ভাবে না।
এসি