প্রয়াণ দিবসে হুমায়ুন ফরিদীকে শ্রদ্ধা
প্রকাশিত : ০৯:২৮, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে উকিল, বাকের ভাইয়ের ভাষায় নাম্বার ওয়ান ‘ধুনকর’, মানে যিনি তুলোধুনো করেন প্রতিপক্ষের উকিলকে; সেই উকিল ইয়াকুব আলী সরকার।
বাকের ভাই এর মামলাটা তিনি হেরে গেলেন বদি’র মিথ্যা সাক্ষীর কারণে। কোর্ট থেকে বদির বেরিয়ে যাবার সময় রাগে গজগজ করে তিনি যখন বদিকে বলেন, ‘বদি, ইচ্ছে করলে এই মামলা আমি ধূলোয় উড়িয়ে দিতে পারতাম, শুধু তোমার কারণে পারি নি… ইউ … ইউ..!’
‘নীতু তোমাকে ভালোবাসি’ নাটকে কাজীর চরিত্র। শমি কায়সার কাজী অফিসে অপেক্ষা করছেন জাহিদ হাসানের জন্য। সেই কাজি অফিসের কাজি তিনি। কিছুক্ষণ পরপর এসে ইচ্ছে করেই শমিকে বিরক্ত করছেন। একবার জিজ্ঞেস করেন, ‘চা খাবেন..?’ আরেকবার জিজ্ঞেস করেন, ‘পত্রিকা এনে দিই..?’
জাহিদ হাসানের আসতে দেরী হওয়ায় শেষমেশ এসে বলেন, ‘ম্যাডাম আপনি চলে যান.. ছেলে আসবে না।’ শমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কেন?’
তখন তিনি ডেলিভার করলেন সেই বিখ্যাত ডায়লগ, ‘এরকম অসংখ্য ঘটনা দেখেছি। ছেলে এসেছে তো মেয়ে আসে নাই, মেয়ে এসেছে তো ছেলে আসে নাই। এমনও হয়েছে যে সাক্ষী দুজন উপস্থিত.. কিন্তু ছেলে-মেয়ে কেউই আসে নাই.. হা! হা! হা!’
জাত অভিনেতা ছিলেন হুমায়ুন ফরিদী, রক্তে মিশে ছিলো অভিনয়, নাট্য জগতের সবাই বুঝে ফেলেছিল ধূমকেতুর জন্ম হয়েছে, একদিন শাসন করবে এই যুবক। সেদিনের হিসেব এক চিলতেও ভুল হয়নি, এরপর টানা তিন দশক তার ক্যারিশম্যাটিক, তার ম্যাজিকাল অভিনয়ে বুঁদ করে রেখেছিলেন পুরো বাঙালি অভিনয় প্রিয় জাতিকে।
২০১২ সালের পর থেকে এ দেশের মিডিয়া জগতে একটি স্থায়ী আফসোস তৈরি হয়েছে। এই আফসোসের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায় প্রায়ই। পরিচালক- হোক সেটা সিনেমা, নাটক, টেলিফিল্ম অথবা মঞ্চের- সবারই এক আফসোস- এমন শক্তিমান অভিনেতা ছাড়া মনের মতো চরিত্র ফুটিয়ে তোলা মুশকিল। সেই মনের মতো চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলার মানুষটি আর নেই! সবার দীর্ঘশ্বাস-‘এ দেশে এ ক্যারেক্টার কেবল ফরিদী ভাই-ই পারতেন।’
ফরিদী নেই, তাই চরিত্রটাও চিত্রায়নের সুযোগ নেই। দীর্ঘশ্বাস বাড়ে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। মিডিয়াপাড়া থেকে টেলিভিশন স্ক্রিন, সিনেমার পর্দা, মঞ্চের আলো-আঁধারি- সব জায়গায় তীব্র হয়ে বাজে তার অনুপস্থিতি। শ্রদ্ধাঞ্জলি বা আবেগ নয়, এটা স্পষ্ট অভাব। অপূরণীয় অভাব। এই অভাব পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণই বলতে হয়। ফাল্গুনের প্রথম দিনে চলে যান তিনি। ওল্ড টাউনের জাদুবাস্তবতার গলি, জাহাঙ্গীরনগরের মুক্তমঞ্চের ওয়াইড অ্যাঙ্গেল এরিনা, থিয়েটারের দিনরাত এককরা মহড়া-প্র্যাকটিস-সংলাপ, এফডিসির রংমহল- সবই কেমন ফাঁকা ফাঁকা- শূন্য। ফরিদীর অনুপস্থিতি তীব্র হয়ে দেখা দেয়। প্রথম ফাগুনের আগুন রঙা দিনে চড়া এক বিষাদের সুর।
জীবনকে যাপন করেছেন আপনি, আপনাকে যাপন করার সুযোগ দেননি৷ প্রবলভাবে বেঁচে ছিলেন আমৃত্যু৷ আপনার বেঁচে থাকা ছিলো গোপনে, গহিনে আশাবাদী মানুষের মতো৷ ঠিক যেমন আমৃত্যু অতি সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা।
১৯৭৮ সালে মাসিক গণসাহিত্য পত্রিকায় তার রচিত ‘ছায়া’ শিরোনামের কবিতাটি আমাদের জানান দিয়ে যায়, তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন সৃষ্টিশীল মানুষ।
‘এই মাটি, মৃত্তিকার গান হঠাৎ হারিয়ে যায়
নিরাকার সন্ধ্যা বৃক্ষের ফোঁকরে বাঁধে বাসা
কুলবতী কালোবউ নদীজলে ধুয়ে ফেরে বাসন-কোসন
হাওয়া কাঁপে হাওয়া, ঘাসের সান্নিধ্যে ঘুমোয়
বিন্দুজলে স্বচ্ছন্দ সংসার সুখ নীচে যত টুনীর পায়ের
একা একা কিশোরীর স্নেহ-ডোবা চোখে ভর করে
দুপুরের নির্জন ভীতি নিসহায় উনুনে পড়ে জল
আমার ঘরের পাশে লম্বিত সুপুরীর গাছ
তবুও অপেক্ষা ক’রে মেঘে মেঘে ভিজে যায় বেলা
এই নদী ভেজে কাক ঘাটে বাঁধা নৌকোর
সুশীল পাটাতন; উচ্ছিষ্ট কচুরীর ফুল।’
জীবনভর শুধু অভিনয়ই করে গেছেন। নিজেই বলতেন ‘অভিনয় ছাড়া আর কিছুই পারি না আমি’। ভীষণ কৌতুকপ্রিয় মানুষ ছিলেন। নাটকের সেটে নাকি সদা সবাইকে কৌতুকে মাতিয়ে রাখতেন। এত কৌতুক মনে রাখেন কীভাবে, প্রশ্নের উত্তরে একবার বলেছিলেন, জীবনটাই তো কৌতুক, আমরা কেউ থাকব না, থাকবে শুধু কৌতুক। নিজের জীবনের সাথে কৌতুক করতে করতে অস্তাচলে যাওয়া হুমায়ূন ফরিদীর অভাব কখনোই পূরণ হবার না।
একান্ত ব্যক্তিজীবনে অসম্ভব অভিমানী এই শিল্পী জীবনকে পিষে-ঘষে-পুড়িয়ে জীবন ধরার চেষ্টা করে গেছেন। এখনো চোখ মুদলে তাঁর অট্টহাসিতে কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনি। বিস্ময় জাগানিয়া অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী এখনো আমাদের ঘোরের মধ্যে নিয়ে যান।
ফরিদী আছেন পৃথিবীর সব নাট্যমঞ্চের ড্রেসিং রুমে, পাটাতনে আছেন রূপোলি পর্দার আড়ালে, থাকবেন অনন্তকাল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হুমায়ুন ফরিদী প্রচুর বাকী খেতেন। তখনকার দোকানদারদের এই বাকী নিয়ে কোনও অভিযোগ নেই, তারা গর্ব করেন।
কথিত আছে যে,
হুমায়ুন ফরিদী একবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, সুমন নামের একজন
ঠাট্টা করে বলেছিলো : ‘আপনার আলবেরুন এর ক্যান্টিনে এখনো ৩১৯ টাকা বাকী রয়েছে, পরিশোধ করে যাবেন’
জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি এইটা পরিশোধ করব না।’
সবাই পরিশোধ না করার কারন শুনতে চায়?
উনি উত্তরে বলেন : আমি এই ক্যান্টিন, হল, ক্যাম্পাস, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা মানুষের কাছে ঋণী হয়ে থাকতে চাই সারাজীবন’
আমাদের একজন হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন, হুমায়ুন ফরীদি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল হৃদয় গভীরের শ্রদ্ধা ভালবাসায় সিক্ত হয়ে।
প্রয়াণ শব্দটা তাই বড্ড বেমানান লাগে তোমায়।
তুমি তাই ছিলে, আছ,থাকবে।
আআ/এসএ/